কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। তবে বুধবার মধ্যরাতে আজাদ কাশ্মিরসহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং তার জবাবে ইসলামাবাদের পাল্টা সামরিক অভিযানে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা আরও ঘনীভূত হয়েছে।এই মুহূর্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে যখন গোটা দক্ষিণ এশিয়া উদ্বেগে, তখন স্মরণযোগ্য হয়ে উঠছে ছয় বছর আগে, ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন। সেখানে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ২০২৫ সালেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধ বাঁধতে পারে, যাতে প্রাণ হারাতে পারে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষ।২০১৯ সালের গবেষণায় কী বলা হয়েছিল?যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কাশ্মীর বিরোধের জের ধরে ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। গবেষকরা বলছেন, এর ফলে জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে অনাহারে মারা যাবে আরো বহু কোটি মানুষ। এরকম এক বিপর্যয়ের ধারণা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আমেরিকার রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।এই যুদ্ধ কীভাবে শুরু হবে তার কিছু সিনারিও বা কাল্পনিক দৃশ্যও গবেষকরা তৈরি করেছেন।দৃশ্য-কল্প ১:ভারতীয় পার্লামেন্টে বোমা হামলা চালাবে একজন সন্ত্রাসী। নিহত হবেন ভারতীয় নেতারা। জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করে আক্রমণ চালাবে। নিজেদের রক্ষার্থে পারমানবিক বোমা ব্যবহার করবে পাকিস্তান। এরপর ভারতও তাদের পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবে। দুটো দেশই তখন তাদের কাছে যতো পরমাণু অস্ত্র আছে সেসব নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।দৃশ্য-কল্প ২:কাশ্মীরে আক্রমণ করবে ভারত। তারপর শুরু হয়ে যাবে পারমাণবিক যুদ্ধ। তবে উভয় দেশে যদি বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন নেতারা ক্ষমতায় থাকেন তাহলে হয়তো এরকম কিছু হবে না, এবং একারণেই এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু এরকম আরো নানা রকমের কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করা যায় যার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যালান রোবোক, যিনি এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “ভারত ও পাকিস্তান তাদের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছে। শুধু সংখ্যার বিচারেই নয়, এসব অস্ত্রের বিস্ফোরণের শক্তিও তারা ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। ফলে তাদের আশঙ্কা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই এই যুদ্ধের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।যুদ্ধের এসব দৃশ্য-কল্প কিভাবে তৈরি করা হয়েছে? এসব কী নিছকই কিছু নাটক? গবেষক অ্যালান রোবোক বলছেন, কিছু পেশাজীবীকে নিয়ে তারা ওয়ার্কশপ করেছেন যেখানে এসব সম্ভাব্য কারণের কথা উঠে এসেছে।”ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া কয়েকজন জেনারেলকে আলাদা আলাদা দুটো কক্ষে বসিয়ে দেওয়া হয়। এক পক্ষকে বলা হয় যেসব কারণে যুদ্ধ হতে পারে তার কিছু ধারণা দিতে। তার পর সেগুলো অন্য আরেকটি কক্ষে অপর গ্রুপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় সেরকম কিছু হলে তারা কী করবেন? এরকম আলোচনার ভিত্তিতেই এসব সিনারিও তৈরি করা হয়েছে।”তবে তিনি বলেন, “এগুলো কিছু দৃশ্য-কল্প। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো কিছু হয় না। নেতারা ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি তো নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে!”কেন ২০২৫?গবেষণা প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, ২০২৫ সালেই যুদ্ধে জড়াতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার চির-বৈরি দুটো দেশ: ভারত ও পাকিস্তান। যুদ্ধের এই সময় কীভাবে নির্ধারণ করা হলো?অধ্যাপক রোবোক বলছেন, ভবিষ্যৎ থেকে তারা শুধু একটি বছরকে বেছে নিয়েছেন। “এই যুদ্ধ যেকোনো সময়ে লাগতে পারে, হতে পারে আগামীকালও। ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন তথ্য থাকে না। কখন কী হবে সেটাও কেউ বলতে পারে না। সেকারণে আমরা কিছু দৃশ্য-কল্প ব্যবহার করেছি কী হতে পারে সেটা বোঝার জন্যে। সেই সম্ভাবনার কথা চিত্রিত করতে আমরা শুধু একটা সময়কে বেছে নিয়েছি।”আসলেই কি ২০২৫ সালে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে?ভারতীয় সেনা বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলছেন, এই গবেষণা একেবারেই কাল্পনিক, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। “লোকেরা ভাবছেন দুটো দেশের আণবিক বোমা আছে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়, তার মানে পাঁচ ছ’বছর পর তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাবে।” তবে তিনি বলেন, ২০২৫ সালে না হলেও যেকোনো সময় এই দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে।এই গবেষণার সাথে একমত প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানে কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুডভাই। তিনি বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনা সবসময়ই আছে।”কোন পরিকল্পনা থেকে নয়, বরং দুর্ঘটনাবশতই এরকম যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। দুটো দেশের মধ্যে যদি অনন্তকাল ধরে উত্তেজনা বিরাজ করে, এবং তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকে, তাহলে তো অনেক কিছুই ঘটতে পারে।”উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “কাশ্মীরের পুলওয়ামার পর বালাকোটে যা হয়েছে, পাকিস্তান এর আরো কঠোর জবাব দিতে পারতো। তখন ভারতও কিছু একটা করতো। এরকম একের পর এক ঘটনায় উত্তেজনা এতোটাই ছড়িয়ে পড়তে পারতো যে পারমাণবিক যুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারতো।””শীতল যুদ্ধের সময় যা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ তার চাইতেও খারাপ। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত একই, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়, ফলে উত্তেজনা শীতল যুদ্ধের চাইতেও বেশি।”কারণ কাশ্মীর?গবেষক অ্যালান রোবোক বলেন, “শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়, হতে পারে ভারত ও চীনের মধ্যেও। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে হওয়ারও অনেক কারণ আছে। তবে আমরা ভারত ও পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছি, কারণ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এ-দুটো দেশের মধ্যে অব্যাহত বিরোধ চলছেই। সামরিক যুদ্ধে জড়ানোর অতীত ইতিহাসও তাদের রয়েছে।”তবে পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী হুডভাই মনে করেন, অন্যান্য কারণ থাকলেও কাশ্মীরই হবে প্রধান কারণ। “কাশ্মীরের পরিস্থিতি যতোই শান্ত করা যাবে, পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিও ততোটা কমে আসবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো সেরকম কিছুই হচ্ছে না। এছাড়াও পরিবেশগত কিছু পরিবর্তনও পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দিতে পারে।””পাকিস্তানের বেশিরভাগ পানি আসে হিমালয় থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের সব হিমবাহ গলে উধাও হয়ে গেলে কাশ্মীর পাকিস্তানের জন্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে পানির উৎসের জন্যে। এ নিয়ে যদি সমঝোতা না হয় তাহলে তো যুদ্ধের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।”সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ব্যানার্জি বলছেন, সন্ত্রাসবাদের মতো আরো কিছু ইস্যুও যুদ্ধের কারণ হতে পারে। “২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা এসে মুম্বাই-এ আক্রমণ করেছিল। এরকম আক্রমণ আবারও হলে তখন পরিস্থিতি অন্য রকমের হয়ে যেতে পারে। “তিনি মনে করেন, পানির কারণেও এই যুদ্ধ হতে পারে। “১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে দুটো দেশের কেউই খুশি নয়। যখন উভয়পক্ষ সমান সমান অখুশি হয় তখন মেনে নিতে হয় যে আমি যদি আরো বেশি খুশি হতে চাই তাহলে আমার প্রতিপক্ষ আরো বেশি অখুশি হবে। তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।”রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান রোবোক বলছেন, পরমাণু শক্তিধর এসব দেশের যেকোনো দু’টোর মধ্যেই পরমাণু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ এমন আরেকটি দেশে আক্রমণ করতে পারে যাদের পরমাণু অস্ত্র নেই।””পরমাণু অস্ত্র যখন আছে তখন পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাও আছে। ইতোমধ্যেই এরকম একটি যুদ্ধ হয়ে গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যা থেকে আমরা ভবিষ্যতেও এরকম যুদ্ধের আশঙ্কা করতে পারি।”যুদ্ধ হলে কী হবে?গবেষক অ্যালান রোবোক বলছেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। “ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমি বলতে পারবো না। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে গত ৭৪ বছরে এই বোমা আর ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের অর্থ হচ্ছে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা যদি এসব ব্যবহার না করি, এগুলো ব্যবহারের যদি যৌক্তিক কোন কারণ না থাকে, তাহলে এসব ধ্বংস করে ফেলা উচিত।”তিনি বলেন, “২০১৭ সালে জাতিসংঘে পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধে একটি চুক্তি সই হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ৩২টি দেশ এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। ৫০টি দেশ অনুমোদন করলেই এটি কার্যকর হবে। তাই এখন বাকি বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত।”গবেষকরা বলছেন, পারমাণবিক বোমা যেখানে পড়বে, শুধু সেখানকারই মানুষই নয়, পুরো বিশ্বের জন্যেই সেটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।জলবায়ু বিজ্ঞানী অ্যালান রোবোক বলছেন, “পারমাণবিক বোমার ফলে আগুন লেগে যাবে, সেই আগুন থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হবে সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। এই ধোঁয়ার কারণে আমাদের এই গ্রহে সূর্যের আলোও ঠিক মতো এসে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে পৃথিবী অনেক ঠাণ্ডা আর অন্ধকারময় হয়ে পড়বে।””ধোঁয়া যখন পৃথিবীর আরো উপরের আবহমণ্ডলে চলে যাবে তখন সেটা সূর্যের আলোতে উত্তপ্ত হয়ে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে যা সেখানে স্থায়ী হবে কয়েক বছর। বৃষ্টিপাত কমে যাবে। তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ঘটবে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনের ওপর। ফলে যুদ্ধের পরেও অনাহারে আরো বহু মানুষের মৃত্যু হবে।”কিন্তু তার পরেও কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লাগতে পারে? পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে ভারতের নীতি হচ্ছে তারা এই অস্ত্র আগে ব্যবহার করবে না। কিন্তু তারাও এখন এই নীতি পুনর্বিবেচনার কথা বলছে। পাকিস্তান সবসময় বলেছে, এরকম অঙ্গীকার করতে তারা রাজি নয়। ফলে দুটো দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ যে কখনোই ঘটবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই।এসকে/আরআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর