চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার পরিক্রমায় ঝরে গেল দুটি প্রাণ। স্ত্রীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত স্বামী ফরিদুল আলম জনতার রোষানলে পড়ে গণপিটুনির শিকার হন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারও মৃত্যু হয়েছে। এই দ্বৈত মৃত্যুর মাঝে অসহায় ও এতিম হয়ে রইলো তাদের তিনটি নিষ্পাপ শিশু।ঘটনার সূত্রপাত গত বৃহস্পতিবার রাতে। বাঁশখালীর বাহারছড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ইলশার অজি আহমদের মেয়ে মিনু আক্তার (৪২) স্বামীর সাথে কলহের জেরে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, সেই রাতে তার স্বামী খানখানাবাদ ইউনিয়নের ডোংরা কালু ফকির বাড়ির মৃত দুধু মিয়ার ছেলে ফরিদুল আলম ওরফে নইমুদ্দিন (৪৫)। শ্বশুর বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত মিনুর চোখে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মিনুর মৃত্যু হয়। ১৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফরিদুল প্রায়শই স্ত্রীকে জাদু-টোনার অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করতেন এবং তাদের মধ্যে বনিবনা ছিল না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ফরিদুল পলাতক ছিলেন। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে স্থানীয় জনতা তাকে খানখানাবাদের ডোংরা এলাকা থেকে আটক করে। স্ত্রীর প্রতি নির্মমতার ক্ষোভে উত্তেজিত জনতা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়, ফরিদুলকে দেওয়া হয় গণধোলাই। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গুরুতর আহত ও রক্তাক্ত ফরিদুলকে উদ্ধার করে। উত্তেজিত জনতা পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে। প্রথমে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। বুধবার ভোরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফরিদুল।এই ঘটনায় মিনুর ভাই বাদী হয়ে ফরিদুলকে একমাত্র আসামি করে বাঁশখালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু সেই মামলার বিচারের আগেই অভিযুক্তের মৃত্যু হলো জনতার হাতে, এমনটাই ধারণা স্থানীয়দের।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলাকাবাসী আক্ষেপ করে বলেন, রাগের মাথায় স্ত্রীকে হত্যা করার পর গতকাল জনগণ তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে তুলে দেয়। দু’জনেই চলে গেলেন। কিন্তু ৩টা ছোট ছোট বাচ্চা এতিম হয়ে গেলো। দেশে আইন নেই বলে বিচার হওয়ার আগেই গণপিটুনিতে মারা গেলো। আইন নিজের হাতে নেওয়া এটাও যে একটা অপরাধ। এটা আর বুঝানো গেলো না কাউকে। বাচ্চাগুলারে দেখেন জাস্ট কত ছোট তারা।তবে, পুলিশের ভাষ্য ভিন্ন। বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুধাংশু শেখর হালদার এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম উভয়েই দাবি করেছেন, জনতার হাতে ধরা পড়ার পর বা মারধরের আগেই ফরিদুল বিষপান করেছিলেন। ওসি জানান, ফরিদুল নিজেই বিষপানের কথা স্বীকার করেছেন এবং এর ভিডিওচিত্রও রয়েছে। জনগণের মারধরের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, জনতা প্রথমে তার বিষপানের কথা বিশ্বাস করেনি। পুলিশ ফরিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করছে।ফরিদুলের স্বজনদের অভিযোগ, বিষপান করলেও তাকে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। গণপিটুনিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছে।স্বামীর হাতে স্ত্রীর খুন, আবার সেই স্বামীকে জনতার পিটিয়ে মারা এই সহিংসতার মর্মান্তিক চক্রে সবচেয়ে বড় শিকার হলো অবুঝ তিনটি শিশু। বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার আগেই গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা সমাজের এক অশনি সংকেতকেই সামনে আনলো, যেখানে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা এবং ক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। দুটি মৃত্যু আর তিনটি এতিম শিশুর কান্না অনেক প্রশ্ন রেখে গেল বাঁশখালীর বাতাসে।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর