চট্টগ্রামের কুখ্যাত ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী শারমিন তামান্নার ‘কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে জামিন কেনার’ ঘোষণা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেই বিতর্কিত বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই উচ্চ আদালত থেকে তিনি পেয়ে গেছেন আগাম জামিন। এই জামিন ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে আদালতের আচরণ, ন্যায়বিচার ও বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে।গত ৯ এপ্রিল (বুধবার) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মাহবুব উল আলম এবং বিচারপতি মো. হামিদুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তার আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। তবে এই জামিন সংবাদমাধ্যমে নয়, প্রথম প্রকাশ্যে আসে আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের-এর একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে।হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বিচারপতি মাহবুব-হামিদুর বেঞ্চে মোট ৫৪৭টি জামিন আবেদন তালিকাভুক্ত ছিল, যেখানে তামান্নার জামিনের ক্রমিক ছিল ৪৬৩ নম্বরে। কিন্তু কৌতূহল জাগায় এই যে, ওইদিন দুপুর ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত মাত্র ১৫০টি মামলার শুনানি হয়। এরপরই হঠাৎ তামান্নার মামলা তুলে নেওয়া হয় এবং মাত্র ১ মিনিটের শুনানিতেই তার জামিন মঞ্জুর হয়ে যায়।সাংবাদিক জুলকারনাইন তার পোস্টে প্রশ্ন তুলেছেন, “১৫০ নম্বরের পর ৪৬৩ নম্বরে থাকা মামলাটি কোন যুক্তিতে শোনানো হলো, আর এত দ্রুত কেন জামিন মঞ্জুর হলো?” তার ভাষ্য মতে, সাধারণত মৃত্যুপথযাত্রী বা চরম বিপর্যয়ের শিকার ব্যক্তিদের মামলায় সিরিয়াল ভাঙা যেতে পারে। কিন্তু এই মামলায় এমন কোন কারণ ছিল না বলে তিনি মনে করেন।গত ১৫ মার্চ, ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মল থেকে সাজ্জাদকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে, ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ সাজ্জাদকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেন। কারণ, সাজ্জাদ তার বিরুদ্ধে থাকা হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ ১৫টির বেশি মামলায় পলাতক ছিলেন এবং প্রকাশ্যে থানার ওসিকে হুমকি দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে আলোড়ন তুলেছিলেন।গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী শারমিন তামান্না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি চমকে দেওয়া ভিডিও বার্তা দেন, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন, “আমার জামাই বীরের বেশে চলে আসবে। আমরা কাড়ি কাড়ি, বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছেড়ে আমার জামাইকে নিয়ে আসব। যারা ভাবে সে আর বের হতে পারবে না, তাদের জন্য এক বালটি সমবেদনা।”এই বক্তব্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, আইনজ্ঞদের মতে এটি দেশের বিচারব্যবস্থা ও নিরাপত্তা সংস্থাকে প্রকাশ্য অবমাননা।সাজ্জাদ গ্রেপ্তারের মাত্র দু’সপ্তাহ পর, ৩০ মার্চ তার অনুসারীরা বাকলিয়ার এক্সেস রোড এলাকায় একটি প্রাইভেট কারে ব্রাশফায়ার চালায়। এতে ঘটনাস্থলে একজন নিহত এবং আরও দুজন আহত হন। নিহত ব্যক্তি ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক আলোচিত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলার অনুসারী।এই ঘটনায় নিহত বখতিয়ার হোসেনের মা ফিরোজা বেগম গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বাকলিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় মূল হুকুমদাতা হিসেবে সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার নাম রয়েছে।এছাড়া মামলার অন্যান্য আসামিদের মধ্যে আছেন মো. হাছান, মোবারক হোসেন, মো. খোরশেদ, মো. রায়হান ও মো. বোরহান।শুধু এখানেই থেমে থাকেনি সাজ্জাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ৬ এপ্রিল, চান্দগাঁও থানার অধীনে বালু ও ইট ব্যবসায়ী তাহসীন হত্যা মামলায়, আদালত দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান সাজ্জাদকে। একের পর এক সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িত এই চক্রটি এখন চট্টগ্রামের জনজীবনে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে, বলছেন স্থানীয়রা।তামান্নার এই ‘বহুল আলোচিত জামিন’ নিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ, বিচার প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকরা চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে— এমন একজন নারী, যিনি আদালতকে প্রকাশ্যে অবমাননার ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি কীভাবে বিচারপতির টেবিলে অগ্রাধিকার পেয়ে ১ মিনিটে জামিন পান?বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনা যদি তদন্তসাপেক্ষে বিশ্লেষণ না করা হয়, তবে তা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করতে পারে।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর