রাজবাড়ী জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কার্যালয়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ঘরের জন্য আবেদন জমা দিতে আসা কৃষকদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ের খবর প্রকাশ করায় এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। তবে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অধিকাংশ কৃষক জানতেনই না কেন তারা মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন।ঘটনার সূত্রপাত ২১ জুন। সময়ের কণ্ঠস্বর ডিজিটাল ও দেশ রূপান্তরে রাজবাড়ী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অফিস সহায়ক এনামুল হকের টাকা নেওয়ার ভিডিও প্রকাশিত হয়। এতে অফিস সহায়ক এনামুল হককে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে দেখা যায়। এ ঘটনার এ ঘটনার প্রতিবাদ ও সাংবাদিকের বিচারের দাবিতে ভুক্তভোগী সাধারণ কৃষকের ব্যানারে কৃষি বিপণন কার্যালয়ের সামনে মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তাদের সোমবার বিকেল থেকে রাত অবধি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তাদেরকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। সাক্ষাতের জন্য কৃষকেরা কার্যালয়ে এলে তাদেরকে জানানো হয়, অফিস নিয়ে এক সাংবাদিক মিথ্যা নিউজ করেছে। এতে করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ঘরের প্রকল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে জেলার সমস্ত কৃষক ঘর পাওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এই প্রকল্প রক্ষার জন্য মানববন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ করতে হবে। নইলে প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। সবাইকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই বিষয়টি অবহিত করার পর ৬০-৭০ জন কৃষক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে আসা কালুখালী উপজেলার মাঝবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক রাশেদ খান বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণ করার জন্য ঘর নিজের টাকায় করতে গেলে প্রায় আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হবে। এই কারণে ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম। গতকাল আমার কাছে অফিস থেকে ফোন করেছিল। আমার কাছে জমির দলিলের ফটোকপি, জমির পর্চা ও আইডি কার্ড জমা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সকালে আসতে হবে। সেটা জমা দিতে অফিসে এসেছিলাম। এসে দেখি অফিসের সামনে অনেক মানুষ। মানববন্ধন হচ্ছে। আমাদের দাঁড়াতে বলা হলো। তবে কী কারণে মানববন্ধন হচ্ছে সেটা জানি না। সবাই দাঁড়িয়েছে তাই আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে ডিসি অফিসে নিয়ে গেলো।আরেক কৃষক বলেন, ঘরের প্রকল্প নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে। এ কারণে সবাইকে অফিসে আসতে হবে। দেখা করতে হবে। অফিস থেকে বলছে আপনারা আসেন দেখা করতে হবে। সেজন্য আসছি। আমাদের দিয়ে সইটই করানো হলো। এরপর দেখি অনেকে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছে। আমাকেও দাঁড়াতে বললো। সবাইকে দাঁড়াতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে গেছি।প্রায় একই কথা বলেন অন্তত ৮/১০ জন কৃষক। এদের অধিকাংশের বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলায়।এদিকে দেশ রূপান্তরের সাংবাদিক হালিম বাবুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা। তারা বলেন, কৃষি বিপণন কার্যালয়ের অনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এভাবে প্রকৃত ঘটনাটি ধামাচাপা বা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।প্রসঙ্গত, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেয়া গণবিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ মে, ২০২৫ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত) এর আওতায় ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে কয়েকটি জেলাসহ রাজবাড়ী জেলার কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলার ২৫ ফুট-১৫ ফুট বিশিষ্ট মডেল ঘর বাঁশ, কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার দ্বারা তৈরি ঘর নির্মাণ করা হবে। মডেল ঘর পেতে আগ্রহী পেঁয়াজ ও রসুন চাষীগণকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ২ কপি ছবি ও জমির পর্চা, স্বহস্তে লিখিত আবেদন জেলা বিপণন কার্যালয়ে ১৯ জুন, ২০২৫ তারিখের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। ১৯ জুন (বৃহস্পতিবার) আবেদনপত্র জমার শেষ দিন ছিল। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় কৃষকদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে প্রতিজনের কাছ থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। আবেদন বাতিলের ভয়ে কৃষকেরাও টাকা জমা দিতে বাধ্য হন।টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা যাচাই করতে সাংবাদিক হালিম বাবু একটি আবেদনের কপি নিয়ে জেলা বিপণন অফিসে গেলে আবেদনপত্রটি জমা দেওয়ার সময় তার কাছ থেকে ২০০ টাকা চান এক কর্মচারী। পরে তিনি ২০০ টাকা আবেদনপত্রের সাথে জমা দিয়ে আসেন। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা ঐ প্রতিবেদক কৃষি বিপণন কার্যালয় ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করে একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলেন। তাদের প্রত্যেকের কাছে ৩০০ টাকা দাবি করেন অফিস সহায়ক মো. এনামুল হক। ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, এক কৃষক তার আবেদনপত্রটি অফিস সহায়ক এনামুল হকের কাছে জমা দিয়েছেন। এনামুল হক আবেদনপত্রটি একটি রেজিস্ট্রি খাতায় তথ্য লিপিবদ্ধ করছেন। এসময় ওই কৃষক তার পরিধান করা পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে হাতের ভেতর রেখেছেন। খাতায় লিপিবদ্ধ করা শেষ হলে হাত পেতে ওই কৃষকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন অফিস সহায়ক এনামুল হক। টাকা নেওয়ার একাধিক ভিডিও রয়েছে।রাজবাড়ী জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা নাঈম আহম্মদ বর্তমানে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে রয়েছেন। ফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রশিক্ষণে থাকায় কিছু বলতে পারছি না। একজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আপনি তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মেহেদি হাসান জানান, ‘আমি বর্তমানে পাবনা জেলায় দায়িত্বে আছি। তবে রাজবাড়ীতে আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আপনার কাছ থেকে জানলাম। রাজবাড়ী গিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’এসকে/আরআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর