রাজশাহীতে ৫০০ বছর আগে নির্মিত হয় বাঘা শাহি মসজিদ। দেশ কিংবা দেশের বাইরে থেকেও দেখতে আসে এই মসজিদটি। আমার বাড়ি (প্রতিবেদকের) বাঘা উপজেলাতেই, সবাই জানলে বা দেখলেও আমার দেখা হয়নি বাঘা শাহি মসজিদের টেরাকোটায় থাকা আমের মোটিফ। মাসে প্রায় ৩-৪ বার বা তার বেশি বাঘাতে যাওয়া হয়। কিন্তু মসজিদটি পর্যবেক্ষণ করে বা ভালোভাবে দেখা হয় না। কথায় আছে ‘নিজের এলাকার বলে কদর নেই’।তাই একদিন মন স্থির করলাম, আমি বাঘা শাহি মসজিদের আমের মোটিফটি দেখবো। আর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো। সঙ্গে নিলাম আমার সহকর্মী নাহিদ ইসলামকে। আমার বাড়ি থেকে ১২ কিমি দূরে মসজিদটি। সেখানে গিয়ে আমের টেরাকোটা খুঁজে পেতে কষ্টই হলো কারণ আমের টেরাকোটাটি মসজিদের ভিতরে আছে, বাইরে নয়। এবার মনে প্রশ্ন আসলো, এতো বড় একটি মসজিদে এতো কিছু রেখে আমের ছবি কেন?সঠিক তথ্য জানতে চলে গেলাম বাঘা উপজেলা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাঘা জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মোঃ দবির হোসেনের কাছে। জিজ্ঞাসা করি, ‘এই মসজিদের গায়ে যে টেরাকোটা গুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তার মাঝে আমের মোটিফ আছে। প্রশ্ন হলো! রাজশাহীতে আরো অনেক কিছুই তো আছে, সেগুলো রেখে আমের ছবি কেন ব্যবহার করলো?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘৫০০ বছর আগে এই বাঘাসহ আশেপাশের মধ্যে কোন জিনিসগুলো বেশি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় ছিল। যেমন ফুলের মাঝে পদ্মফুল ও গোলাপ, ফলের মধ্যে আনারস, আম ও বেদানা এবং বিভিন্ন অলংকার। আর এই সকল বিষয়গুলো স্মৃতি হিসেবে বাঘা মসজিদে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রাজশাহীর বাঘা শাহি মসজিদ নির্মিত হয় ৫০০ বছর আগে। মসজিদের টেরাকোটায় থাকা আমের মোটিফ দেখে বোঝা যায়, বাঘার আমের ঐতিহ্য কত প্রাচীন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বাজারে বাঘার ফজলি ও ক্ষীরশাপাতি আম ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। ‘নাটোর ম্যাঙ্গো’ নামে পরিচিত ওই আমের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন কলকাতার মানুষ।১৮১৩ সালের আগপর্যন্ত রাজশাহী জেলার অন্তর্গত ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘আহা, তিনি দুপুরের খাবারের পর আয়েশ করে আমটা খেতে পারলেন না!’ এর মাধ্যমে ১২০৫ সালে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের মুখে লক্ষ্মণ সেনের পলায়নের প্রসঙ্গ বোঝানো হয়। এতে হাজার বছর আগেও রাজশাহীর আমের কত কদর ছিল, সেটা প্রতীয়মান হয়।ইতিহাসে আছে, রাজশাহীতে আমের প্রচলন করেছিলেন তৎকালীন রাজা ও জমিদারেরা। তাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিখ্যাত আমের চারা এনে এ অঞ্চলে বাগান করেন। এ ছাড়া ছোট-বড় ব্যক্তি উদ্যোগেও জেলায় আমবাগান করার রীতি গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সাধারণ চাষি পর্যায়ে আমবাগানের উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ে।বাঘা উপজেলার সর্ববৃহৎ ও উল্লেখ করার মতো আমবাগান আছে পুরোনো হাজড়াপাড়া গ্রামে। বাগানটির আয়তন ২০০ বিঘার বেশি। মালিক ছিলেন জমিদার বিনোদবিহারী হাজরা। দেড়শ বছরের পুরোনো বাগানটির পরবর্তী সময়ে মালিক হন আবদুল মজিদ দেওয়ান ও মো. সোলেমান দেওয়ান। এলাকাটি বাগবাগিচার জন্য প্রাচীন আমল থেকে সুপরিচিত। ১৬০৯ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বার্তা নিয়ে আসা আবদুল লতিফ তাঁর রোজনামচায় বাঘা মসজিদ, মাদ্রাসাসহ আম, কাঁঠালসহ বেহেশততুল্য এলাকাটির কথা উল্লেখ করেন।বাঘার বাউশা, মনিগ্রাম, পাকুড়িয়া ইউনিয়নের আম সর্বোৎকৃষ্ট। পৌরসভার মধ্যে বলিহার মহল্লার আম বেশি দামে বিক্রি হয়। উপজেলার আড়পাড়া, কলিগ্রাম, চকছাতারী, বারোখাদিয়া, বলিহার, বাউশা, হাবাশপুর, মনিগ্রাম, পানিকামড়া, জোত কাদিরপুর, নারায়ণপুর, হরিণা, তেঁতুলিয়া, আড়ানী গ্রামে ছোট-বড় শত শত বাগান আছে। আড়ানী কুশাবাড়িয়া গ্রামে বড়াল নদের দক্ষিণ পাড়ের আমবাগানটির বয়স প্রায় ৮০ বছর। আড়ানী থেকে বাঘা ১০ কিলোমিটার পথের দুই ধারে শুধুই আমবাগান। জেলার মধ্যে বাঘা ও চারঘাট আম চাষে সবচেয়ে এগিয়ে। এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর