চট্টগ্রামের দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সাতকানিয়ায় বছরের পর বছর ধরে চলছে বৈধ-অবৈধ ইটভাটার দৌরাত্ম্য। বেশিরভাগ ইটভাটা কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলেও, বাস্তবে তা চলছে আগুনের মতো। এসব ইটভাটা শুধু পরিবেশ নয়, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, বনজ সম্পদ—সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে নিঃশব্দে।সাতকানিয়ায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে উত্তর ঢেমশা, দক্ষিণ ঢেমশা, তেমুহনী, রসুলাবাদ ও দক্ষিণ ছদাহা এলাকায়। সাতকানিয়ার পশ্চিমে বাঁশখালী সীমান্ত এলাকায় পাহাড় ঘেঁষে এওচিয়া ছুড়ামনি ও ছনখোলা এলাকায় পাহাড়ের পাশে রয়েছে কয়েকটি ইটভাটা। এসব এলাকার যে দিকে চোখ যায়, দেখা যায় ধোঁয়ার স্তম্ভ। ভাটাগুলো থেকে নির্গত হয় ঘন কালো ধোঁয়া, যাতে রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান।ঢেমশা ইউনিয়নের অবস্থিত একাধিক ভাটার পাশেই আছে বসতি এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাত হলেই বাতাস ভারী হয়ে যায়। ঘরের ভিতর পর্যন্ত কালো ধোঁয়ার গন্ধ আসে। অনেকে হাঁপানিতে ভুগছে।পরিবেশবিদদের মতে, এই ধোঁয়া দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, এখানে শিশুদের মধ্যে সর্দি, কাশি, চর্মরোগ, অ্যালার্জির রোগ বাড়ছে। বিশেষ করে ইটভাটার পাশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে এসব লক্ষণ বেশি।সাতকানিয়ার উর্বর সমতল ভূমিতে আগে বছরে ধান ও শাক-সবজি চাষ হতো। এখন এসব জমি ব্যবহৃত হচ্ছে মাটি কাটার জন্য। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের নির্মাণাধীন রেললাইন ঘেঁষে উত্তর ঢেমশা ও তেমুহনী মৌজায় একাধিক চক্র শতশত একর কৃষিজমি ভাটা নির্মাণের জন্য ধ্বংস হয়েছে। জমির উপর চাপ দিয়ে চলেছে ট্রাক, ডাম্পার, লোডার—সবকিছু।পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী, কোনো ভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, সাতকানিয়ার অধিকাংশ ভাটাই অনুমোদনহীন।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতকানিয়ায় ৭২টি ইটভাটার মধ্যে চলতি বছর চালু আছে ৫৫টি। একটি ভাটার মালিকের কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মালিক প্রতি বছর কিছু ‘ম্যানেজমেন্ট কস্ট’ দেয়, তাই ঝামেলা হয় না।জানা যায়, এই “ম্যানেজমেন্ট কস্ট”-এর মধ্যে রয়েছে প্রশাসন, থানা, পরিবেশ অধিদপ্তর, ভূমি অফিসের ‘চাঁদা’।ইটভাটার নির্গত গ্যাস বায়ুমণ্ডলের গ্রীনহাউস গ্যাস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এতে স্থানীয় তাপমাত্রা বাড়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের গতিও ত্বরান্বিত হয়।বাংলাদেশে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী— কৃষিজমিতে ভাটা স্থাপন করা যাবে না। জনবসতির ১ কিমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২ কিমির মধ্যে ভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ ও জিগজ্যাগ প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাতকানিয়ার ভাটাগুলোর ৭৫% এসব শর্ত লঙ্ঘন করে চলছে।উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম বলেন, আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়েছি কয়েকবার, জরিমানাও করেছি। কিন্তু মালিকরা মামলা ঠেকাতে উচ্চ পর্যায়ে চলে যায়।বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রশাসন গাছ লাগায়, বক্তৃতা দেয়, মাইক বাজায়। কিন্তু প্রকৃতির ওপর যাঁরা প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করছে—তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সাতকানিয়ার চিত্র তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।পরিবেশ কেবল একটি দিবস নয়, এটি প্রতিদিনের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শুধু সাতকানিয়া নয়, পুরো দেশের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।এইচএ
Source: সময়ের কন্ঠস্বর