মাঠের ধান কাটা শেষ। ধানগাছের কান্ডে পুনরায় গজিয়েছে কচি পাতা। সেগুলো দক্ষিণা বাতাসে দুলছে। এই নতুন পাতার মতোই এখানকার মানুষের মনেও তাড়া দিচ্ছে উৎসবের ঢেউ, যে উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে। এটা নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি! বলছি বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর থেকে তিন কিমি পশ্চিমে অবস্থিত কুসুম্বী ইউনিয়নের কেল্লাপোশী গ্রামের মেলার কথা।রবিবার (২৫ মে) থেকে শুরু হয়েছে মেলা। তিথি অনুযায়ী প্রতিবছরের জ্যেষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার থেকে মেলা শুরু চলে তিনদিন।তিনদিন ব্যাপী মেলা শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকে আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষের মাঝে বিরাজ করে অন্যরকম আমেজ। থাকতে হবে আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি। গৃহ আঙিনাকেও সাজাতে হবে ভিন্নভাবে- যেন সাজ-উৎসবের ক্ষণ।তবে এ মেলাটিকে যে যেই নামেই ডাকুক না কেন? সকলে বিশ্বাস করে যে এই মেলাটিই এই অঞ্চলে ‘মেলার রাজা’। তাইতো স্থানীয় ও আশপাশের মানুষ থেকে শুরু করে বহু দূর থেকেও অনেকে ছুটে আসেন এই মেলায়। ‘মেলার রাজা’ খ্যাত এই মেলা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। প্রায় ৫ শতাব্দী থেকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ৩ কিলোমিটার অদূরে কুসুম্বী ইউনিয়নের কেল্লাপোশী নামক স্থানে এ মেলা বসছে। এবার বেশ জমজমাট মেলা হবে বলে আশাবাদী আয়োজক কমিটি।স্থানীয়দের কাছে এটি ‘মাদারের মেলা’ ও ‘জামাইবরণ’ মেলা নামেও পরিচিত। সকলে বিশ্বাস করে যে এই মেলাটিই ‘মেলার রাজা’। এই মেলা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত আছে হাজারটা গল্প।এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হচ্ছে এই বলে;‘কেল্লাপোশী মেলার রাজামাদার পীরের চামর পূজা,মেলা নয়তো, ঠেলার বাজার,লোক জমে যায় হাজার হাজার,মেলা নামের ফাঁককেবল কিচড় পাঁক।’জনশ্রুতিতে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে বৈরাগনগরের বাদশা সেকেন্দারের ছেলে ছিলেন গাজী মিয়া। আর কালু মিয়া ছিলেন তার দত্তক পুত্র। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা দুই ভাই রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণনগরে আসেন। ব্রাহ্মণ রাজা মুকুটের ছিল সাত পুত্র ও এক কন্যা চম্পাবতী। বাংলা সাহিত্যে যা ‘সাত ভাই চম্পা’ নামে পরিচিত। চম্পাবতী গাজীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান।মুকুট রাজা ছিলেন যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ। কালু ঘটক হিসেবে রাজা মুকুট রায়ের দরবারে গিয়ে গাজীর সঙ্গে চম্পাবতীর বিয়ের কথা উত্থাপন করলে কালু বন্দী হন। ফলে গাজীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধল মুকুট রাজার। মুকুট রাজার কাছ থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য গাজী মিয়া কেল্লাপোশী নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। যুদ্ধে রাজা মুকুটের পরাজয় ঘটে। গাজী ও চম্পাবতী পরিণয়ে আবদ্ধ হন।পুঁথির ভাষায়,‘সাত শত গাড়ল লয়েদাবার ঘাট পার হয়েগাজী চললেন খুনিয়া নগরখুনিয়া নগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়েগাজী বিয়ে করলেন কৌশল্যা সুন্দরী।’গাজী ও চম্পাবতীর সেই শুভ পরিণয় হয়েছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং পরবর্তীতে সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই চলে আসছে এ মেলা।এই মেলা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে থাকে নানা আয়োজন। এরই একটি হচ্ছে মাদার খেলা। মেলা শুরুর সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে এ খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানা সরঞ্জাম আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের পাড়া-মহল্লাতেও খেলা দেখায়। দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার তা শেষ করে।আর এ মেলাকে কেন্দ্র করে আনন্দ উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় থাকে লাখো মানুষ। তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিমন্ত্রণে থাকে নতুন-পুরনো জামাই-বউ রয়েছেন তালিকার শীর্ষে শ্বশুরালয়ে আসা জামাইরা ভিন্ন মৌজ মাস্তিতে থাকেন। কারণ মেলা উপলক্ষে জামাইদের মোটা অঙ্কের সেলামি দিয়ে থাকেন শশুররা। তখন জামাইবাবুরা সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুরবাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগরদেলা, হুন্ডা খেলা, জাদু খেলা, পুতুল নাচ দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরি খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন।এ মেলায় সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বিচিত্রা, হোন্ডাখেলা, কারখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। দূরদূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন।এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুটির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। আর মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের আসবাবপত্র, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারাবছরের জন্য কিনে রাখেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। যেহেতু মেলাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে, তাই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের বিশেষ টহলের ব্যবস্থার কমতি থাকেনা।সংশ্লিষ্ট শেরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. এসএম মঈনুদ্দিন বলেন, আমি এ থানায় নবাগত। ওই মেলার ঐতিহ্যের কথা জেনেছি। তবে যাই হোক মেলায় কোনো অশ্লীল যাত্রা, জুয়া বা অনৈতিক কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে না। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।এমআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর