রাজশাহী জেলা পুলিশ লাইনস ব্যারাকে নেমে এলো এক গভীর শোক। তৃতীয় তলার টয়লেটের জানালার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল পুলিশ কনস্টেবল মো. মাসুদ রানার নিথর দেহ, বয়স মাত্র ৩৪। পরিবার ও পেশা তার জীবনের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত যেন হেরে গেলেন তিনি।নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার পাঁচশিশা এলাকার সন্তান মাসুদ রানা ছিলেন একনিষ্ঠ এক পুলিশ সদস্য। কর্মরত ছিলেন বাগমারার জুগিপাড়া তদন্ত কেন্দ্রে। কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে অবস্থান করছিলেন পুলিশ লাইনস ব্যারাকে। কিন্তু কে জানত এই ব্যারাকই হবে তার জীবনের শেষ ঠিকানা?সহকর্মীদের ভাষায়, মাসুদ ছিলেন একজন শান্ত ও দায়িত্ববান পুলিশ সদস্য। মুখে সবসময়ই ছিল এক অনাবিল হাসি। তবে তার সেই হাসির আড়ালে যে এক গভীর মানসিক যন্ত্রণা বাসা বেঁধেছিল, তা কেউ বুঝতে পারেননি।রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম জানান, ধারণা করা হচ্ছে, পারিবারিক কলহ ও মানসিক সমস্যার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।এই মন্তব্যের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে হাজারো অপূর্ণতা, চাপা কান্না, এবং একটি অস্থির মনের আর্তনাদ। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে আলোচনা খুব একটা হয় না। দীর্ঘ সময়ের কর্মঘণ্টা, পেশাগত ঝুঁকি, নিম্নআয়ের চাপ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এসবই একজন পুলিশ সদস্যের জীবনে দগদগে বাস্তবতা।একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে মানসিক অবসাদ, হতাশা ও আত্মহত্যার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এই ঝুঁকি কমাতে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যবস্থা এখনো নেই বললেই চলে।একজন সহকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাসুদের পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। মাঝে মাঝে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতেন। কিন্তু আমরা কখনো ভাবিনি, তিনি এমন কিছু করে বসবেন। মাসুদ রানা শুধু একজন পুলিশ সদস্যই ছিলেন না, ছিলেন কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও বাবা বা ভাই। তার হঠাৎ বিদায়ে কেবল পুলিশ বাহিনী নয়, তার পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে।কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই আত্মহত্যার দায় শুধু ব্যক্তিগত হতাশার, না কি একটি বৃহত্তর সামাজিক ব্যর্থতার? মানসিক চাপের কথা আমরা কবে বুঝব? কবে গুরুত্ব দেব?মাসুদের মরদেহ এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। পরিবারটি তখন শুধুই এক নীরব কান্না নিয়ে ফিরে যাবে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই।এই ঘটনা কেবল একটি মৃত্যুর খবর নয়, এটি একটি সিস্টেমিক সংকেত। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মানবিক চাহিদা, মানসিক ভারসাম্য, এবং পারিবারিক জীবনের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। সমাধান এক দিনে আসবে না, কিন্তু আমরা চাইলে শুরু করতে পারি। যেন আর কোনো মাসুদ রানা নিঃশব্দে অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর