রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার গোকুল মথুরা গ্রামের শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ যেন আজ অস্তিত্ব সংকটে। সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একদল অসাধু মহল মাঠটিকে দখল করে সেখানে ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। তবে তারা বসে নেই। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ১১টায় শতাধিক গ্রামবাসী, স্থানীয় তরুণ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহ মাঠ রক্ষায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন লং মার্চ ও অবস্থান কর্মসূচির।এটি নিছকই একটি মাঠ নয়। এটি ছিল গোকুল মথুরা গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন গড়ার জায়গা, খেলাধুলার কেন্দ্রবিন্দু, উৎসব আয়োজনের প্রাণ। অথচ সেই মাঠের মাঝখানে এখন চুন-সুরকি পড়ে আছে, বেড়া দেওয়া শুরু। কে বা কারা করছে এই কাজ? কার নির্দেশে এই দখল প্রক্রিয়া?স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী মহল এই জমি নিজের মালিকানা দাবি করে ভবন নির্মাণ করতে চায়। যদিও মাঠটি সরকারি হিসেবে পরিচিত, এবং “খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০” অনুযায়ী এর ব্যবহার পরিবর্তন করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সেই আইনও এখানে যেন কোনো কাজে আসছে না।এদিন গোকুল মথুরা খেলার মাঠেই আয়োজিত হয় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ। অংশগ্রহণ করেন শতাধিক গ্রামবাসী, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং শিশু-কিশোরসহ তরুণরা। ব্যানার হাতে, স্লোগান কণ্ঠে তারা জানিয়ে দেন, “মাঠ আমাদের অধিকার, রক্ষা করতেই হবে।”কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন মো. হারুন-অর-রশিদ। বক্তব্য দেন মো. রুবেল হোসেন মিন্টু (সভাপতি, স্বপ্নচারী যুব উন্নয়ন সংস্থা), মো. শামীউল আলীম শাওন (সভাপতি, ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস), হাফিজুর রহমান, আলম প্রামাণিক প্রমুখ। বক্তারা আইনগত দিক তুলে ধরেন এবং এই দখলচেষ্টাকে “সংবিধান ও আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন” বলে দাবি করেন।একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে। দখলকারীদের দাবি, তারা এখানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে চায়। তবে প্রশ্ন উঠেছে—শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম করে কি অন্য উদ্দেশ্য লুকানো হচ্ছে? বক্তারা বলেছেন, “শিক্ষার মান উন্নয়ন চাই, কিন্তু সেটা মাঠ ধ্বংস করে নয়। খেলার মাঠের জায়গায় ভবন নয়, বিকল্প জায়গায় হোক উন্নয়ন।”তারা আশঙ্কা করছেন, ভবনের আড়ালে হয়তো জমি বাণিজ্যের পায়তারা চলছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র হয়তো সরকারি জায়গা দখল করে পরবর্তীতে বেসরকারি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়।খেলার মাঠ রক্ষা আইন অনুযায়ী, মাঠের শ্রেণী পরিবর্তন করা কিংবা অন্য কোনোভাবে ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশাসন কেন এখনো পদক্ষেপ নেয়নি?স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাঠ দখলের প্রক্রিয়া শুরু হলেও কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি, নেই কোনো সরকারি প্রকল্পের সাইনবোর্ড। এ বিষয়ে তানোর পৌর কর্তৃপক্ষ নিরব ভূমিকা পালন করছে।এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, তারা ১৫ এপ্রিল (মঙ্গলবার) রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অভিমুখে লং মার্চ করবেন এবং শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ করবেন।স্থানীয় তরুণদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা মাঠ দখলের যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে “শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ় প্রতিরোধ” গড়ে তুলবেন। তবে যেহেতু দখলচেষ্টাকারীরা অজানা শক্তি দ্বারা মদদপুষ্ট, তাই ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামাজিক উত্তেজনা ও সংঘর্ষের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।গ্রামবাসীদের দাবি পরিষ্কার মাঠ রক্ষা করতেই হবে। তারা চায়, প্রশাসন দ্রুত মাঠের মালিকানা ও ব্যবহার আইনি ভাবে নিশ্চিত করুক এবং দখলচেষ্টাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনুক।এই সংকট শুধু গোকুল মথুরার নয়, এটি দেশের প্রতিটি পৌর এলাকার উন্মুক্ত স্থানের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। খেলার মাঠ হারালে হারাবে একটি প্রজন্মের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ, হারাবে মানবিকতার বীজ।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর