প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা শুধু নদীমাতৃক পরিবেশের জন্যই নয়, বরং একটি অনন্য মিষ্টান্নের জন্যও সুপরিচিত। এ মিষ্টির নাম ‘নড়িয়া সন্দেশ’। প্রায় ২০০ বছর ধরে গৌরবের সঙ্গে চলে আসা এই মিষ্টির সুনাম আজ দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।জনশ্রুতি অনুসারে, ব্রিটিশ আমলের নৌপথ কীর্তিনাশা নদীর তীরে গড়ে ওঠা নড়িয়া বাজারে প্রথম সন্দেশ তৈরির প্রচলন হয়। সেখানকার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা এলাকার নাম অনুসারে মিষ্টির নাম দেন ‘নড়িয়া সন্দেশ’। তখনকার যাত্রীরা, বিশেষ করে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা, নৌভ্রমণের বিরতিতে এই সন্দেশ খেয়ে মুগ্ধ হতেন এবং সঙ্গে করে বহন করতেন।বিশেষ এই মিষ্টান্ন প্রস্তুতের পদ্ধতিও যথেষ্ট নিখুঁত। নড়িয়া ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পরিচালক বিমল ঘোষ জানান, “প্রায় ছয়-সাত কেজি দুধ থেকে এক কেজি ছানা পাওয়া যায়। সেই ছানায় সমপরিমাণ খাঁটি চিনি মিশিয়ে ২০-৩০ মিনিট অল্প আঁচে রান্না করতে হয়। এরপর আরও কয়েক মিনিট হালকা আঁচে রেখে তৈরি হয় সন্দেশের মিশ্রণ। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো কৃত্রিম রঙ, ফ্লেভার বা সংরক্ষক ব্যবহার করা হয় না।”এই বিশুদ্ধতা ও হাতে গড়া গুণগত মানই সন্দেশটিকে করেছে অনন্য। এক সময় নড়িয়ায় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকানে এই সন্দেশ তৈরি হতো। তবে বর্তমানে সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ছয়-সাতটিতে। পেশাগত টিকে থাকা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারিগরদের জন্য।বিমল ঘোষ বলেন, “দুধ ও চিনি—সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। লাভ কমেছে, কিন্তু গুণগত মানে আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। আমাদের দাদা-পরদাদারা এই ব্যবসা করেছেন, আমরাও তা ধরে রাখছি। এটা শুধু ব্যবসা নয়, আমাদের ঐতিহ্য।”প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছেও নড়িয়া সন্দেশ এখন পরিচিত নাম। অনেকেই বিদেশে আত্মীয়দের জন্য এই মিষ্টি নিয়ে যান।সন্দেশপ্রেমী প্রবাসী রুবেল খান জানান, “শৈশবে যেটা ছিল শুধু উৎসবের মিষ্টি, এখন সেটা আত্মপরিচয়ের অংশ। বিদেশিরাও এই স্বাদ পেয়ে বিস্মিত হন।”শরীয়তপুরের প্রবীণ সাহিত্যিক শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, “নড়িয়ার মানুষ যেখানেই যাক না কেন, সন্দেশের প্যাকেট তাদের সঙ্গে থাকবেই। এটি যেন আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।”তবে এই ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, আধুনিক বিপণন কৌশলের অভাব এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এই শিল্প টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠছে। সঠিক সহায়তা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ পেলে নড়িয়া সন্দেশ হতে পারে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের অন্যতম প্রতিনিধি।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর