সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে একের পর এক বাংলাদেশি নাগরিককে পুশ ইন করার ঘটনা বাড়ছে। গত দুই মাসে অন্তত সাত দফায় ১১৪ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে বিএসএফ পরিকল্পিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে কূটনৈতিক অস্বস্তি তো তৈরি হয়েছেই, সীমান্ত এলাকায় উদ্বেগও বাড়ছে।ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৫৬ বিজিবি’র আওতাধীন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ৭৬ জন এবং ১৮ বিজিবি’র আওতায় থাকা সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনসহ মোট ৮১ জনকে পুশ ইন করেছে। এর মধ্যে চারজন ভারতীয় ছিলেন।বিজিবি সূত্র জানায়, ৫৬ বিজিবি’র দায়িত্বাধীন ১৪৭ কিলোমিটার ও ১৮ বিজিবি’র আওতায় ১৩৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ বিজিবি’র ২২ কিলোমিটার ও ১৮ বিজিবি’র ৫ কিলোমিটার এলাকায় এখনো তারকাঁটার বেড়া না থাকায় এসব উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। বিশেষ করে ৫৬ বিজিবি’র ২২ কিলোমিটার উন্মুক্ত সীমান্ত এলাকায় এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।সূত্র জানায়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে বা সীমান্তের বৈদ্যুতিক বাতিগুলো নিভিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে এসব মানুষকে বাংলাদেশে পুশ ইন করছে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এ ঘটনায় প্রতিবারই আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা জানিয়েছে এবং প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছে।জানা যায়, ১৬ মে গভীর রাত থেকে ১৭ মে দুপুর পর্যন্ত বোদা উপজেলার মালকাডাঙ্গা ও ডানাকাটা সীমান্ত দিয়ে অন্তত ১১ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করা হয়। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার নারী-পুরুষ ও শিশুরা রয়েছে। ভারতের মুম্বাইয়ে আটক হওয়ার পর ১২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে শিলিগুড়িতে পাঠানো হয়, সেখান থেকে ১১ জনকে পঞ্চগড় সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করে বিএসএফ।এ ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় ২২ মে দিবাগত রাতে জয়ধরভাঙ্গা বড়বাড়ি সীমান্ত দিয়ে আরও ২১ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করা হয়। এর মধ্যে ১৩ জনই শিশু। জানা গেছে, গুজরাট থেকে তাদের আটক করে কলকাতায় এনে বিএসএফের মাধ্যমে সীমান্তে পাঠানো হয়। পরে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।৩ জুন ভোররাতে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। এবার বড়বাড়ী ও খুনিয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ির ২৬ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়। এদের মধ্যে নয়জন নারী, আটজন পুরুষ এবং নয়জন শিশু রয়েছে। আটক ব্যক্তিরা জানান, তারা দীর্ঘ ১০-১৫ বছর ধরে ভারতে অবস্থান করছিলেন। সম্প্রতি ভারতের সিআইডি পুলিশ তাদের আটক করে বিএসএফের মাধ্যমে ফেরত পাঠায়।১৩ জুন পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা দিয়ে আজ ভোরে সাতজনকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। তাঁদের মধ্যে ২ জন পুরুষ, ৩ নারী ও ২ শিশু আছেন। তাঁদের বাড়ি নড়াইল ও যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় বলে জানা গেছে। তাদের মুম্বাই ও আশপাশের এলাকা থেকে আটক করেছিল ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।১৪ জুন ভোরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার মিস্ত্রীপাড়া সীমান্ত ও তেঁতুলিয়ার শালবাহান রোড সীমান্ত দিয়ে আরও ১৬ জন বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিককে পুশ ইন করা হয়। এর মধ্যে চারজন ভারতীয় নাগরিকও ছিল, যাদের পরে বিএসএফের সাথে পতাকা বৈঠক করে ফেরত পাঠানো হয়।২৫ জুন ভোরে সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের প্রধানপাড়া, অমরখানা ইউনিয়নের টোকাপাড়া এবং তেতুঁলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের শুকানি সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়। পুশইন হওয়া ১৮ জনের মধ্যে ৬ পুরুষ, ৪ জন নারী ও ৮ জন শিশু রয়েছে। ভারতীয় পুলিশ তাদের গুজরাট থেকে আটক করে। আটককৃতরা নড়াইল জেলার বাসিন্দা ছিলেন। পরে প্রয়োজনীয় আইনী প্রক্রিয়া শেষে তাদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়।সবশেষ ৫ জুলাই সদর উপজেলার চাকলাহাট ও অমরখানা সীমান্ত দিয়ে ১৫ বাংলাদেশি নাগরিককে বাংলাদেশে পুশ-ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ফেরত পাঠানোদের মধ্যে পাঁচজন নারী, পাঁচজন পুরুষ ও পাঁচটি শিশু রয়েছে।স্থানীয় বিজিবি সূত্র বলছে, ভারতের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আটক করে এসব বাংলাদেশি নাগরিককে বিমান ও সড়কপথে এনে সীমান্তে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিএসএফ। অথচ দুই দেশের মধ্যে পুশ ইন প্রথা নিষিদ্ধ এবং এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। বিজিবি পুশ ইন ঠেকাতে প্রতিবার কড়া প্রতিবাদ জানালেও বিএসএফ তাতে কর্ণপাত করছে না।এ বিষয়ে ১৮ বিজিবি’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরুল ইসলাম বলেন, দিনে অথবা রাতে কোন সময়ই পুশ ইনের কোন বৈধতা নাই। আমাদের দেশের মানুষ যদি সেখানে অবৈধ ভাবে থাকে তাহলে তাদের হস্তান্তরের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা হাইকমিশনের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া আছে সেটা অনুসরণ করতে হবে। পুশ ইন ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় স্বাভাবিকের তুলনায় টহল জোরদার করা হয়েছে। আমাদের ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডার পর্যায়ে ইতিমধ্যে বিএসএফকে জানানো হয়েছে যে সেখানে যদি বাংলাদেশী মানুষ থাকে তাহলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী আমাদের জানান। আমরা সে অনুযায়ী তাদের ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।৫৬ বিজিবি’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পেট্রোল দ্বিগুণ করা হয়েছে। গত দেড় মাসে বিজিবি সদস্য ও স্থানীয়দের সম্পৃক্ততায় ভারতের পুশ ইনের ৫টি প্রচেষ্টা আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি। আমরা ব্যাটালিয়ান, কোম্পানি এবং বিওপি পর্যায়ে বিএসএফের সাথে পতাকা বৈঠক করছি যেন এধরণের পুশ ইন না হয়। মানুষকে সচেতন করতে এবং পুশ ইন ঠেকাতে সপ্তাহে দুই দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় মাইকিং হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশী কোন নাগরিক ফেরত আসতে চাইলে আমাদের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে জানাতে বলা হয়েছে বিএসএফকে। পতাকা বৈঠকে তাদের বাংলাদেশী পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে আমরা তাদের গ্রহণ করব। পুশ ইন বন্ধে কয়েকবার লিখিত প্রতিবাদলিপিও দেওয়া হয়েছে বলেও জানান বিজিবি’র এই কর্মকর্তা।এদিকে সীমান্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন বাড়ার পেছনে দুই দেশের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এর পাশাপাশি ভারতের অভ্যন্তরে স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের আইনি প্রক্রিয়া ছড়া পুশ ইন করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বিষয়টিতে দ্রুত কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছে তারা।পুশ ইন হওয়া অনেকেই সাংবাদিকদের জানান, বছরের পর বছর ভারতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তারা। অনেকে পরিবারসহ গিয়েছিলেন, কেউ কেউ বিয়ে করে সেখানেই ছিলেন। কিন্তু কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ করে পুলিশ আটক করে তাদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, যে হারে নারী-শিশুসহ বাংলাদেশি নাগরিকদের পুশ ইন করা হচ্ছে, এতে সামাজিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও প্রভাব পড়তে পারে।এসকে/এইচএ
Source: সময়ের কন্ঠস্বর