রাজশাহীর সিএনবি মোড় তখন অনেকটাই নির্জন। বৃহস্পতিবার (০৫ জুন) রাত সাড়ে দশটা। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি রিকশা, কিছু পথচারী, দূর থেকে ভেসে আসা ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল। হঠাৎ চোখে পড়ে ফুটপাত ঘেঁষা এক নিথর দেহ। প্রথমে মনে হয়, কেউ বুঝি ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝা গেল, এটি নিছক ঘুম নয়, বরং এক নিরব আর্তনাদ। নিঃশ্বাস আছে ঠিকই, কিন্তু জীবনের স্পন্দন কোথাও নেই।এ যেন এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি—যেখানে গোটা দেশের ‘শিক্ষা চত্বর’ বলে খ্যাত এলাকা রাজশাহীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রশ্নচিহ্ন। কী কাজে আসে এই শিক্ষার সার্টিফিকেট, যদি সে শিক্ষিত সমাজ এমনভাবে একজন অসহায় মানুষকে পাশ কাটিয়ে যায়?রাজশাহীর পরিচয় বহন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজ, এবং নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চারদিকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক—বাংলাদেশের অন্যতম জ্ঞানকেন্দ্র বলা চলে এই শহরকে। কিন্তু এই জ্ঞানপীঠের ঠিক মাঝখানে, এমন করুণ বাস্তবতা যেন রীতিমতো কষে থাপ্পড় মারে আমাদের বিবেককে।সিএনবি মোড়ের ঠিক পাশেই শহীদ কামারুজ্জামান চত্বর, পাশেই বিপণিবিতান, বইয়ের দোকান, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল। অথচ ঠিক তার মাঝখানে রাতভর পড়ে থাকে একটি মানুষ।কে সে? কী তার পরিচয়? কোথা থেকে এসেছে? কোথায় যাবে? কেউ জানে না। কারো জানার আগ্রহও নেই।ফুটপাতের পাশে বসে থাকা এক চা বিক্রেতা জানালেন, ‘ভাই, ওই মানুষটা অনেকদিন ধরেই আশেপাশে ঘোরে। কখনো এখানে ঘুমায়, কখনো রেলস্টেশনের দিকে চলে যায়। খায় কীভাবে জানি না। কারো কিছু চায়ও না। কেউ কিছু দেয়ও না।’কথা বলার সময় তার কণ্ঠেও তেমন সহানুভূতির ছোঁয়া ছিল না। বরং একরকম বিরক্তিই ছিল চোখেমুখে। যেন এই মানুষটির এখানে পড়ে থাকা তাদের ব্যবসার ব্যাঘাত ঘটায়।রিকশাচালক আলাল হোসেন বলেন, ‘ভাই, আমি তো প্রায়ই দেখি ওই লোকটারে। মাঝে মাঝে রাতের বেলা ফুটপাতে শুইয়া থাকে। কারো কাছে কিছু চায় না, চুপচাপ থাকে। কোনদিন দেখি নাহারি হোটেলের পেছন দিক থেইক্যা কিছু খাইতেছে, কোনদিন আবার না খাইয়া ঘুমায়। মানুষজন আসে যায়, কেউ থামে না।’তিনি একটু চুপ থেকে বললেন, ‘এই শহরে সবাই ব্যস্ত, কেউ কারো দিকে তাকায় না। আমি নিজের রিকশা চালাই, সংসার চালাইতে কষ্ট হয়, কিন্তু ওই লোকটারে দেখলে মনটা খারাপ হয়। দুই টাকার বিস্কুট কিনে দিছিলাম একদিন, লইছিল। কোনো কথা কয় নাই, শুধু চাইলার মতো তাকায়া থাকছিল।’তার গলায় ক্ষোভও শোনা গেল, ‘এহন রাজশাহীতে কত বড় বড় অফিস, কত শিক্ষিত মানুষ! কিন্তু একজন অসহায় মানুষ ফুটপাতে পইড়া থাকে আর কেউ একটা কম্বলও দেয় না—এইডাই কষ্টের। পড়াশুনা কইরা মানুষ যদি মানবতা না শিখে, তাইলে লাভটা কী?’চারপাশে মোটরবাইক নিয়ে ছুটে চলা তরুণ, কলেজ ফেরত ছাত্রীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক—সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কারো একবারও মনে হয় না থেমে জিজ্ঞেস করতে, ‘ভাই, আপনি ঠিক আছেন তো?’আজকের বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার, বিসিএস ক্যাডাররা গর্বভরে বলেন, ‘আমি রাজশাহীতে পড়েছি।’কিন্তু সেই রাজশাহীর রাস্তায় যখন একটি মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন তাদের চোখে যেন কিছুই পড়ে না। ঈদের মৌসুমে তারা লাখ টাকার বোনাস নিয়ে শপিং মলে যান, দামি রেস্টুরেন্টে খেতে যান, বিদেশি পণ্য কিনে ছবি দেন ফেসবুকে। কিন্তু শিক্ষা নগরীর মাঝখানে পড়ে থাকা এই দেহের দিকে একবারও ফিরে তাকান না।এ ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে, বিশেষত বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রশাসনিক এলাকায় এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যাদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তারা সরকারি খাতায় নেই, পরিসংখ্যানে নেই, উন্নয়নের চিত্রেও নেই। তারা কেবল পড়ে থাকে—কখনো রেললাইনের পাশে, কখনো ফুটপাথে, কখনো কোনো ডাস্টবিন ঘেঁষে।এদের পাশে দাঁড়ানো কি শুধু সমাজকর্মীদের কাজ? এদের জন্য কি কেবল এনজিও-ই দায়ী? যে সমাজ নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করে, তার কি কোনো দায় নেই?রাজশাহীর সিটি করপোরেশন কি চায়নি এর জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করতে? কোনো সরকারি হেল্পলাইন কি রয়েছে যারা এই মানুষগুলোর কাছে যায়? কিছু বছর আগে রাজশাহীতে ‘সিটি শেল্টার’ নামে একটি প্রকল্পের কথা শোনা গিয়েছিল, যার মাধ্যমে রাতে ঘুমানোর মতো জায়গা দেওয়া হবে অসহায়দের। কিন্তু তার কার্যকারিতা বা সম্প্রসারণ আজও অনিশ্চিত।সরকারের দায়িত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি নাগরিকদেরও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেকের ছোট একটি উদ্যোগ হয়তো এই নিথর মানুষটির জীবনে নতুন আলো জ্বালাতে পারে।শিক্ষা কেবল পুস্তক আর সার্টিফিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা হলো মনুষ্যত্ব, সহানুভূতি, এবং দায়িত্ববোধ শেখার জায়গা। যে শিক্ষা মানবিকতা শেখায় না, সে শিক্ষা দিয়ে কেবল চাকরি হয়—সমাজ বদলায় না।সিএনবি মোড়ের সেই নিথর মানুষটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, হয়তো আজ রাতেও তার ঈদ নেই। আমরা ঈদের বাজারে ব্যস্ত, আর সে পড়ে আছে নিঃশব্দে—শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। আমরা কি পারি না—একটু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি দেখাতে?এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর