একদিকে কৃষির মাঠ, অন্যদিকে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্যানেল—একই জমিতে যুগপৎ এই দুটি কার্যক্রমের সম্মিলন এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তবের দিকেই এগিয়ে চলেছে। এর নাম এগ্রোভোল্টাইক্স বা ‘বিজলি কৃষি’। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫-এর প্রাক্কালে রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরের বিশাল মাঠজুড়ে এমনই এক স্বপ্ন বুনেছে পরিবেশ ও উন্নয়নকর্মীরা।বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে বুধবার (৪ জুন) দুপুরে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয় এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রচারণা কর্মসূচি। এটি আয়োজন করে পরিবর্তন, উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন) এবং বাংলাদেশ প্রতিবেশ ও উন্নয়ন কর্মজোট (বিডাব্লিউজিইডি)। আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল—সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষকদের মাঝে এগ্রোভোল্টাইক্স সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই প্রযুক্তিকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারের জন্য নীতিগত সহায়তা আদায়।‘পরিবর্তন’ এর পরিচালক রাশেদ রিপন বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ, কিন্তু জমির পরিমাণ সীমিত। অন্যদিকে, দেশের বিদ্যুৎচাহিদাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সেক্ষেত্রে এই দুই সংকটের একযোগে সমাধান দিতে পারে এগ্রোভোল্টাইক্স।’সামনে ছিল পদ্মার বিস্তৃত চর, যেখানে স্থানীয় কৃষকদের কৃষিকাজ হয় মৌসুমি ভিত্তিতে। এদিন সেই জমিতে সৌরপ্যানেল স্থাপনের একটি মডেল উপস্থাপন করা হয়, যাতে দেখা যায় কীভাবে জমির উপর উচ্চতায় সৌরপ্যানেল বসিয়ে নিচে চাষাবাদ সম্ভব। প্রযুক্তিটি মূলত এমনভাবে পরিকল্পিত যাতে সূর্যালোকের যথাযথ ব্যবহার হয়—একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, অন্যদিকে ফসলের জন্য পর্যাপ্ত আলো পৌঁছায়।কর্মসূচিতে জলবায়ু কর্মীরা হাতে ধরেছিলেন রঙিন পোস্টার। উন্নয়নকর্মী জুলফিকার আলি হায়দার, পঙ্কজ কর্মকার, এবং সোমা হাসান নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মাঠপর্যায়ের কাজ নিয়ে। তারা বলেন, এ প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দরকার সরকারের সক্রিয় ভূমিকা, বিশেষ করে নীতিমালা, প্রশিক্ষণ এবং মডেল প্রকল্প।বাংলাদেশ একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে, অন্যদিকে রয়েছে জ্বালানি সংকট। সেই সাথে শহরায়নের চাপে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এই বাস্তবতায় এগ্রোভোল্টাইক্স প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে একটি যুগান্তকারী সমাধান। এতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়, কৃষক বাড়তি আয়ের সুযোগ পায়, আবার জাতীয় পর্যায়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জোগানও বাড়ে।জলবায়ু কর্মী সোমা হাসান বলেন, ‘যদি কৃষকের জমিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাও করা যায়, তাহলে জমি না হারিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।’আয়োজক সংগঠনগুলি সরকারের প্রতি তিনটি মৌলিক দাবি তুলে ধরেন: এগ্রোভোল্টাইক্স বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষামূলক মডেল প্রকল্প বাস্তবায়ন, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদান।তারা বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হলে তা কেবল রাজশাহী নয়, বরিশাল থেকে রংপুর—সারা দেশের কৃষকরা উপকৃত হবেন।এই প্রচারণা শুধু এক দিনের আয়োজন নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ আন্দোলনের সূচনা। অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, তারা আগামী দিনগুলোতে জেলা ও উপজেলায় গিয়ে কৃষকদের সাথে মতবিনিময় সভা, ভিডিও প্রচার, মাঠ প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে এগ্রোভোল্টাইক্স প্রসারে কাজ করবেন।পরিবর্তন-এর সমন্বয়ক রাশেদ রিপন বলেন, ‘আমরা চাই এটি শুধু ধারণা হয়ে না থাকে, বাস্তবায়নের পথে যাক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, টেকসই ও নবায়নযোগ্য বাংলাদেশ গড়তে হলে এই ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে।’রাজশাহীর পদ্মার চর থেকে আজ যে বার্তা দেওয়া হলো, তা কেবল একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নয়—সমগ্র দেশের কৃষি ও জ্বালানি নীতিতে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে। এগ্রোভোল্টাইক্স যেন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ‘সবুজ বিপ্লবের নতুন ধারা’—এই আশা নিয়েই শেষ হয় আয়োজন।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর