বাঁশখালীতে সড়কের কার্পেটিং কাজের সপ্তাহ না যেতেই হাত দিয়ে টান দিলেই উঠে যাচ্ছে। এতে করে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি রাতে সড়কের কার্পেটিং কাজ করার অভিযোগে বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে উপজেলা প্রকৌশলীর হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।ঘটনার সূত্রপাত বুধবার (১৩ মে) দিবাগত রাত ৩টায়। ছনুয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মাতব্বরপাড়া এলাকায় মাওলানা আশরাফ আলী সড়কের কার্পেটিং কাজ করছিল ঠিকাদারের লোকজন। এসময় নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও দিনে কাজ না করে রাতে কাজ করার অভিযোগ তুলে ঠিকাদারের লোকজনের সাথে স্থানীয় জনতার কথা-কাটাকাটি হয়। খবর পেয়ে বাঁশখালী থানা থেকে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন উপজেলা প্রকৌশলী কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদ। এসময় উত্তেজিত জনতা উপজেলা প্রকৌশলীর মোবাইল কেড়ে নেয় এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী জাকের উল্লাহ বলেন, রাউজান থেকে উপকরণ বানিয়ে এনে তেল না দিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে কাজ করছিল ঠিকাদারের লোকজন। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রতিবাদ করলে প্রকৌশলী ফাহাদ বিন মাহমুদ আমাকে মামলায় জড়ানোর হুমকি দেয়। পরে সাদা পোশাকে আসা তিনজন পুলিশ সদস্য আমাকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে উঠাতে চাইলে জনগণ প্রতিবাদ করে। জনগণের প্রতিবাদে প্রকৌশলী ও পুলিশ সদস্যরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।তিনি আরও বলেন, আমরা বাধা দেওয়ার পর তেল নিয়ে আসছে। এর আগে তেল ছাড়া কার্পেটিং করেছে। এখানে লবণ ছাড়া আর কিছুর চাষ হয় না। মূলত কাজে চুরি করার জন্য ধান মাড়াই করার অজুহাত দেখিয়ে রাতে কার্পেটিং কাজ করেছে।উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দুটি প্যাকেজে এক কোটি ৮২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ছনুয়া মাওলানা আশরাফ আলী সড়কের ছয় হাজার মিটার রাস্তার সংস্কার করে কার্পেটিং করার কার্যাদেশ পান নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুজ্জামান আরিফের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিসিএইচ ইন্টারন্যাশনাল। অভিযোগ রয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী আরিফুজ্জামান আরিফ পলাতক। পলাতক আরিফের সাথে যোগাযোগ রেখে প্রকৌশলী নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। প্যাকেজের ৬ হাজার মিটারের মধ্যে আনুমানিক ৫ হাজার মিটার থেকে সড়কের কার্পেটিংয়ের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিম্নমানের বিটুমিন, পাথর, সুড়কিসহ অন্যান্য উপকরণ দিয়ে কার্পেটিং করায় কাজ সম্পন্ন হয়। তবে এর এক মাসের মধ্যে ওই প্যাকেজের প্রায় ১০০ মিটার সড়কের কার্পেটিং উঠতে শুরু করে। পাশাপাশি পুরো সড়ক জুড়েই দেখা দেয় ফাটল। স্থানীয় বাসিন্দারা সদ্য সংস্কার করা সড়কের কার্পেটিং হাতে টেনে তুলতে দেখা যায়।স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সড়কটি সংস্কার করেছেন। শুরু থেকেই এলাকাবাসী উন্নতমানের উপকরণ দিয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানালেও ঠিকাদার তা আমলে না নিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সড়কে কার্পেটিং কাজ সম্পন্ন করেছে। এ বিষয়ে এলাকাবাসী উপজেলা প্রকৌশলীকে একাধিকবার জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।অভিযোগ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদ বলেন, প্রতিটি কাজে একটু-আধটু ত্রুটি থাকে। ১০০ ফুটের মতো জায়গায় একটু কাজের মান খারাপ হয়েছে। তাদের দাবি ছিল, দিনেই যেন কাজ করা হয়। কিন্তু রাতের বেলা কাজটি করা হয়েছে। সেখানে লোকজন রাস্তায় দিনে ধান ও খড় মাড়াই করে। রাস্তা বন্ধ থাকে। তাই রাতে করেছি জনগণের যেন অসুবিধা না হয়।মামলার ভয় দেখানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কাউকে মামলার ভয় দেখাইনি। এলাকার লোকজনকে কেউ হয়তো রাস্তার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে।তবে এলাকাবাসীর দাবি, ঘটনাস্থলের আশেপাশে কোথাও ধান চাষ করা হয় না। সেখানে লবণ চাষ করা হয়।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিসিএইচ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আরিফুজ্জামান আরিফ বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্ল্যান্ট না থাকায় রাউজানে গিয়ে প্ল্যান্ট থেকে উপকরণ আনতে হচ্ছে। রাতে বাঁশখালী প্রধান সড়ক ফাঁকা থাকে। মালামালের গাড়ি চলাচলে সুবিধা হয়। দিনে তো যানজট থাকে। তাই রাতে কার্পেটিং করা হচ্ছে। আগামীকাল (শুক্রবার) ইঞ্জিনিয়ারের উপস্থিতিতে স্থানীয় লোকজন যেভাবে বলে সেভাবেই কাজ করে দেওয়া হবে।এদিকে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় পুনরায় সড়কের কার্পেটিং কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন প্রকৌশলী ফাহাদ বিন মাহমুদ। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রকৌশলী ফাহাদ বিন মাহমুদ বলেন, নিরাপত্তা শঙ্কায় বৃহস্পতিবারও কার্পেটিং কাজ করা সম্ভব হয়নি।বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, কনস্ট্রাকশনের কিছু কাজ রাতে করতে হয়। নখ দিয়ে ঘষা দিলে পিচ ঢালাই উঠে যাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। কাজের গুণগত মান ঠিক আছে কিনা সেটি আমি দেখবো। কাজের মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয় নিয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে আলাপ করবো।প্রসঙ্গত, এর আগে বাঁশখালীর আসহাব উদ্দিন সড়ক, প্রেম বাজার থেকে সরলিয়া বাজার সড়ক ও ছনুয়া মৌলভী নজরুল ইসলাম সড়কের উন্নয়ন কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে।কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদের ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে গণস্বাক্ষর নিয়ে তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেছেন বাঁশখালীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ফাহাদ বিন মাহমুদকে প্রতিটি প্রকল্প থেকে টেন পার্সেন্ট দিতে হয়। ফাইল পাস ও রাস্তার প্রাক্কলন প্রস্তুত করার জন্য টাকা না দিলে তিনি পা বাড়ান না।জানা গেছে, ২০২১ সালের ৬ জুন বাঁশখালী উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করা কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদের শ্বশুর আবুল বাছেত মোহাম্মদ রেজাউল বারী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের আইসিটি শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। এর সুবাদে দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে আছেন ফাহাদ বিন মাহমুদ। বাঁশখালীতে ফাহাদ বিন মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার ৫ বছর অতিক্রম করলেও তাকে বদলি করা হয়নি।পিএম
Source: সময়ের কন্ঠস্বর