রাজশাহীর রাজনীতির ময়দানে সহিংসতার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। ক্ষমতা, আদর্শ আর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ বহুবার ঘটেছে। কিন্তু এসব সংঘর্ষের বলি যখন সাধারণ মানুষ হন, তখন প্রশ্ন ওঠে—রাজনীতির এই আগুন আর কত নিরীহ প্রাণ কেড়ে নেবে?সম্প্রতি রাজশাহীতে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে এমনই এক নির্মম ঘটনা ঘটেছে। সেই সংঘর্ষের বলি হয়েছেন ৪৮ বছর বয়সী রিকশাচালক গোলাম হোসেন ওরফে রকি। তিনি কোনো দলের কর্মী ছিলেন না, ছিলেন একজন শ্রমজীবী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে হারিয়ে গেলেন একেবারেই সাধারণ এক জীবন।গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহীর দড়িখড়বোনা এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন দলীয় নেতা-কর্মীরা। শুরু হয় ককটেল বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ, লাঠিসোঁটা নিয়ে মারামারি।এই সহিংসতার মধ্যেই কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন রিকশাচালক গোলাম হোসেন। তিনি তখন হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক পক্ষের কর্মীরা তাঁকে বিরোধী দলের সদস্য ভেবে ছুরিকাঘাত করে।তিনি তখন রাস্তার ধারে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ছুরিকাঘাতে তাঁর বুকে গুরুতর আঘাত লাগে, মাথায়ও আঘাত ছিল। অচেতন অবস্থায় দীর্ঘ চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।রিকশাচালকের ওপর নৃশংস এই হামলার পরেও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল হতাশাজনক। নগরের বোয়ালিয়া থানার ওসি মোস্তাক হাসান জানান, তিনি এমন কোনো ঘটনার কথা জানেন না। অথচ হাসপাতালের মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, গোলাম হোসেন ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যু সংঘর্ষেরই পরিণতি।গোলাম হোসেনের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার সাহেবপাড়ায়। জীবিকার তাগিদে তিনি রাজশাহীতে এসে বসবাস করছিলেন, স্ত্রীকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি কাজ শেষে ঘরে ফিরছিলেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে আর ঘরে পৌঁছাতে দিল না।গোলাম হোসেনের মৃত্যুতে পরিবার এখন নিঃস্ব। তাঁর একমাত্র উপার্জনের উৎস ছিল রিকশা চালানো। স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী এখন দিশেহারা। অথচ এই মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক মহল থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী (ঈসা), সদস্যসচিব মামুনুর রশিদ এবং বিএনপির উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিরীহ মানুষের নিহত হওয়া যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় সংঘর্ষে হামলা হয়, আহত হয় সাধারণ মানুষ, কিন্তু অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। গোলাম হোসেনও সেই বিচারহীনতার শিকার হলেন।প্রশ্ন থেকে যায়—এই হত্যার বিচার হবে কি? প্রশাসন কি দায়ীদের খুঁজে বের করবে? নাকি অন্য অনেক ঘটনার মতো এটিও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে সময়ের আড়ালে?গোলাম হোসেনের মৃত্যু কেবল তাঁর পরিবারের জন্য ক্ষতি নয়, এটি সমাজের জন্যও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারণ, যখন রাজনীতি সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তখন সেটি আর গণতন্ত্রের অংশ থাকে না, বরং হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর দানব। এই দানবকে রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও অনেক গোলাম হোসেনের মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে। আমরা কি সেই ভবিষ্যৎ চাই?এমআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর