বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলাম এর এই বাণীর সর্বশেষ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। অভ্যুত্থানে সরব অংশগ্রহণ ছিলো নারী শিক্ষার্থীদের।৬ জুলাই দেশজুড়ে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা রাজপথে অবস্থান করছে, ঠিক তখনই শহীদ আবু সাঈদ এর পরামর্শে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া সাবিনা ইয়াসমিন।রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার জুম্মাপাড়া গ্রামের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থী সাবিনা। কোটা নামক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সম্মুখ সারিতে ছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে জানান সেসময়কার অভিজ্ঞতা এবং আগামীতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তুষার আচার্য্য….সময়ের কণ্ঠস্বর: কীভাবে এবং কেন আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হলেন?সাবিনা ইয়াসমিন: ২০২৪ এর ৭ জুন যখন সুপ্রিম কোর্ট কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে তখনই কিন্তু আন্দোলনের শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন শুরু করে। এমন অবস্থায় জুলাই এর ৬ তারিখ আমি আমার বিভাগের ছোট ভাই শহীদ আবু সাঈদকে কল করি। তাকে আমি বলি, আমিও তোমাদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবো। তখন সাঈদ আমাকে বলে, আপু আমাদের তো মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই এখনো, তাই আপনি সবাইকে বলে একটু নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে আমি সবার সাথে যোগাযোগ করে আমরা মেয়েরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। মেধার চেয়ে কোটার গুরুত্ব বেশি ছিল। কিন্তু সেটা কেন হবে। পুরুষ হোক কিংবা নারী যে মেধার দিক থেকে যোগ্য সেই চাকরি পাবে, সেখানে কোটা নামক বাড়তি সুবিধা দিয়ে কেন মেধাবীকে অবমূল্যায়ন করা হবে। মূলত এই কারণেই আমি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংযুক্ত হই।সময়ের কণ্ঠস্বর: আন্দোলনকালীন সময়টা কেমন ছিল এবং প্রতিবন্ধকতা ছিল কিনা?সাবিনা ইয়াসমিন: আমাদের মেয়েদের জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কেননা প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নিষেধ ছিল, সময়মতো হলে ফেরার কড়াকড়ি নির্দেশ ছিল আবার পরিবার থেকেও সম্পূর্ণভাবে নিষেধ ছিল। কিন্তু এতোকিছুর পরেও আমরা পিছুপা হইনি। অনেকভাবে আমাদের ভয় দেখানো হতো, চাপ দেয়া হতো যেন আমরা আন্দোলনে না যাই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আমার এক সহপাঠীকে একজন সেক্সুয়ালি হ্যারাস করে। বিভিন্নভাবে নিয়মিত তাকে কলে হুমকি দেয়া হতো। কিন্তু তারপরেও মনোবল না হারিয়ে আমরা রাজপথে ছিলাম।সময়ের কণ্ঠস্বর: আন্দোলনের সময় কী দায়িত্ব পালন করতেন এবং শহীদ আবু সাঈদের সাথে কিভাবে সংযুক্ত ছিলেন?সাবিনা ইয়াসমিন: আন্দোলনচলাকালীন সময়টাতে মূলত আমি অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং তথ্য আদানপ্রদান করতাম। শুধু আমি না আমরা অনেকেই এটা করতাম। সেইসাথে আমাদের যে ব্যানারগুলো ছিলো সেগুলোতে কী লেখা হবে তা ঠিক করতাম। আর সাঈদের সাথে সবসময় মোবাইলে কথা হতো এবং আন্দোলনে দেখা হতো।সময়ের কণ্ঠস্বর: শহীদ আবু সাঈদের নিহতের পরের সময়টা কেমন ছিল?সাবিনা ইয়াসমিন: সাঈদকে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হলো ওই সময়টা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। পরিবার থেকে চাপ দেয়া হচ্ছিল যেন বাড়িতে চলে যাই। আবার পুলিশের বাঁধা, ছাত্রলীগের হুমকি সব মিলিয়ে সেই সময়টা কখনোই ভোলার নয়। এরপর তো ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয় তাই বাধ্য হয়ে বাড়িতে চলে যাই। পরবর্তীতে আবার ২রা আগষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয় এবং আমি ৪ঠা আগষ্ট আসি বাড়ি থেকে। কিন্তু বাড়িতে থাকাকালীন সময়টিতেও সংযুক্ত ছিলাম, যোগাযোগ রক্ষা করতাম।সময়ের কণ্ঠস্বর: বিপ্লবোত্তর কেমন বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন এবং এখন কেমন দেখছেন? সাবিনা ইয়াসমিন: আমাদের বিপ্লবটা বেহাত হয়ে গিয়েছে। খুবই দুঃখ হচ্ছে এখন। হতাশা কাজ করছে। এমন বাংলাদেশ তো দেখতে চাইনি। বৈষম্যমুক্ত একটি বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম, যেখানে আইনের শাসন থাকবে কিন্তু এখনকার চিত্র পুরো আলাদা। এখন শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ’র নাম নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।তাদের আত্মত্যাগকে ও আদর্শকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না, ধারণ করা হচ্ছে না। অবৈধ কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য এখন তাদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ৫ই আগষ্ট ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরে যেমন বাংলাদেশ আশা করেছি তেমনটা পাচ্ছি না। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন সব মিলিয়ে একদমই খারাপ পরিস্থিতি। আমার নিজেকেও এখন অনিরাপদ মনে হয়, কিন্তু আমি অনেক সাহসী একজন মেয়ে। আমার মনে হয় যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আছেন তারা বিপ্লবকে ধারণ করতে পারেননি বা কোন চাপে আছেন। তা না হলে এমন পরিস্থিতি কেন দেখতে হবে।সময়ের কণ্ঠস্বর: বিপ্লব বেহাত হয়ে যাওয়ার কথা বললেন কিন্তু সেটি কেন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?সাবিনা ইয়াসমিন: আন্দোলনকারীরা এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। যেই একতা ছিলো জুলাই আগষ্টে সেটা এখন নেই। যার কারণেই এটি হয়েছে। আপনি লক্ষ্য করুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলো কিন্তু সেখানেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রশ্ন তুলছে বৈষম্যের। এমন আরও অনেক বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদি সবাই একসাথে থেকে পরিকল্পনা করে দেশ পূর্ণগঠনের জন্য কাজ করা যেতো তাহলে এখনকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।সময়ের কণ্ঠস্বর: আন্দোলনের ফলে কী কী ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?সাবিনা ইয়াসমিন: দেখুন মানুষ আগে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতো কিন্তু তারাই সংযুক্ত থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আবার শিক্ষার্থীদের মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়া হতোনা কিন্তু এখন তা গুরুত্ব পাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো কিন্তু আন্দোলনের ফলেই হয়েছে, এছাড়াও এমন অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে।সময়ের কণ্ঠস্বর: ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কে কেমন দেখতে চান?সাবিনা ইয়াসমিন: আমরা এই আন্দোলনটি করেছিলাম বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাই অবশ্যই প্রথমে চাই দেশে সকল বৈষম্য দূর হোক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক এবং মেধাবীদের যোগ্য মূল্যায়ন দেয়া হোক। এখনো আশা করছি সংস্কার হবে এবং নতুন একটি বাংলাদেশের নির্মাণ হবে। যেখানে নারীদের সুরক্ষা থাকবে, আইনের সঠিক প্রয়োগ থাকবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।সময়ের কণ্ঠস্বর: নারী হিসেবে আপনার প্রত্যাশা কী?সাবিনা ইয়াসমিন: বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বপ্রথম প্রত্যাশা নারীদের সুরক্ষা দেয়া হোক। এখন নারীরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ না। আন্দোলনসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য কিন্তু নারীদেরকেই বেশি সমস্যা পোহাতে হয়। তাই আমার প্রত্যাশা নারীদের জন্য বাসযোগ্য নিরাপদ দেশ গঠিত হবে।সময়ের কণ্ঠস্বর: আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?সাবিনা ইয়াসমিন: আমি ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে শিশু শিক্ষা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে চাই। আমি আমার সাধ্যমতো শিক্ষাক্ষেত্রে ও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে চাই।সময়ের কণ্ঠস্বর: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।সাবিনা ইয়াসমিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
Source: সময়ের কন্ঠস্বর