মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান ফাহমিদুল হাসান। কিশোর বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রাম থেকে স্বপ্ন নিয়ে কুমিল্লা শহরে আসা, ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে। ক্লাস শেষে ছুটে যান টিউশনি করতে—সেই আয়ে চলে থাকা, পড়াশোনা, আর অসুস্থ মায়ের ওষুধ।মায়ের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল ফাহমিদুলের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন রূপ নিয়েছে দুঃস্বপ্নে। ‘ভালো চাকরি’ ও ‘লাখপতি হওয়ার’ প্রলোভনে পড়ে নিজের কষ্টার্জিত টাকার একটি বড় অংশ বিনিয়োগ করেন ‘তিয়ানশি’ নামের এক কথিত চাইনিজ কোম্পানিতে।প্রতিবেদককে ফাহমিদুল বলেন, “আমি শুধু একটা ভালো জীবন চেয়েছিলাম। মা’কে ভালো রাখতে চেয়েছিলাম। এখন তো তাকে বলতেও পারি না—ওই টাকাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি…”—এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন তিনি।এটি শুধু ফাহমিদুলের গল্প নয়। তাঁর মতো কুমিল্লার শত শত শিক্ষার্থী আজ একই প্রতারণার শিকার। নিষিদ্ধ মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ‘তিয়ানশি’ আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে কুমিল্লা শহরে। নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার খন্দকার টাওয়ারের ৮ম তলায় চলছে নিয়মিত সভা, প্রশিক্ষণ ও পণ্যের প্রচার। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই চক্র ‘চাকরি’ ও ‘বিদেশ যাওয়ার সুযোগ’-এর নামে শিক্ষার্থীদের ফাঁদে ফেলছে।২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এমএলএম ব্যবসা নিষিদ্ধ করে। তিয়ানশি সে সময় কার্যক্রম বন্ধ করলেও, সম্প্রতি ‘চাইনিজ হেলথ প্রোডাক্ট’ এর মোড়কে আবার শুরু করেছে প্রতারণা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত ‘বড় ভাই’ বা ‘আপু’দের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করছে তারা। শুরুতে ৫-১০ হাজার টাকা ‘ইনভেস্টমেন্ট’ চাওয়া হয়, পরে ধাপে ধাপে আরও আদায় করা হয় হাজার হাজার টাকা।ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী নুসরাত জাহান বলেন, “মেসে ওঠার পর এক আপু পরিচয় দেয় তিয়ানশির। সেমিনারে গিয়ে শুনি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ, লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন। আমি ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি, এটা একটা ফাঁদ ছিল।”তিয়ানশির পণ্যের মধ্যে রয়েছে হারবাল চা, ব্যথানাশক তেল, দাঁতের পেস্ট, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ইত্যাদি। যেগুলোর স্থানীয় বাজার মূল্য ৩০-৫০ টাকা হলেও বিক্রি করা হয় ৪০০-৫০০ টাকায়। এসব পণ্যের নেই কোনো প্রমাণিত গুণগত মান, এমনকি বিএসটিআই অনুমোদনও মেলে না।কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন, “তিয়ানশির মতো চক্র শুধু টাকা নয়, শিক্ষার্থীদের স্বপ্নও ছিনিয়ে নেয়। আমরা যারা পরিবারকে সাহায্য করতে চাই, জীবনে কিছু হতে চাই—তাদের জন্য এসব প্রলোভন ভয়ানক। একবার ঢুকে গেলে বের হওয়া কঠিন।”তিয়ানশির স্থানীয় কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা প্রোডাক্ট বিক্রি করি, কেউ চাইলে মেম্বার হয়। জোর করে টাকা নেই না। তিয়ানশি ৩৩ বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছে।”তবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান রওনক আরা বেগম বলেন, “এই চক্রগুলো তরুণদের এমনভাবে আকৃষ্ট করে যেন জীবন বদলে যাবে। বাস্তবে তারা হারায় অর্থ, সময় আর আত্মবিশ্বাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে এদের থামাতে হবে।”বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানজিদ আহমেদ বলেন, “চীনা লেখা ও লেবেলযুক্ত পণ্যের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে। কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়াই এসব পণ্য বাজারজাত করা হয়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসেছে। যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”তবে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাইফুল মালিক বলেন, “তিয়ানশির বিষয়ে আমরা এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।”এ বিষয়ে জানতে জেলা পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমেদ খানকে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।এনআই

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
দেশ সংস্কারে দরজা এখনো খোলা আছে: নাহিদ ইসলাম
দেশ সংস্কারে দরজা এখনো খোলা আছে: নাহিদ ইসলাম

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাচনী সমঝোতা নয়, দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে এখনো আমাদের দরজা খোলা রয়েছে। তবে Read more

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলে কাউকে ছাড় নয়: চাঁদপুর বিএনপি সভাপতি
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলে কাউকে ছাড় নয়: চাঁদপুর বিএনপি সভাপতি

চাঁদপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও বাড়ি বা ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলা না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন