বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহী এখন মাছ উৎপাদনের এক বড় কেন্দ্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ তাজা রুই, কাতলা, মৃগেল ও অন্যান্য দেশীয় মাছ পৌঁছে যায়, তার একটি বড় অংশ আসে এখানকার দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী, মোহনপুর, বাগমারা, তানোর, পুঠিয়া, পবা, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার শত শত পুকুর থেকে।প্রায় দুই দশকের চেষ্টায় এখানকার মাছচাষিরা একটি শক্তিশালী মৎস্যভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন। কিন্তু চলতি বছর হঠাৎ অজানা এক ভাইরাসে মাছ মারা যাওয়ায় সে কাঠামোতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। চাষিরা বলছেন, শুধু এই মৌসুমেই রাজশাহীর মাছচাষে শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে তারা।গোদাগাড়ীর কমলাপুর বিলে মাছচাষি মাইনুল ইসলাম বলেন, আমার তিনটি পুকুরে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। শীতের পরে পুকুরে জাল ফেলতেই মাছ মরতে শুরু করে। মাত্র ৭ দিনের মধ্যে দুই লাখ টাকার মাছ মরে ভেসে ওঠে। তার দাবি, শুধুমাত্র কমলাপুর বিলেই অন্তত ৪০টি পুকুরে মাছ মারা গেছে। প্রত্যেকটিতে গড়ে ২-৫ লাখ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে। ‘‘আমাদের বিলে অর্ধ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়ে গেছে।একই চিত্র দুর্গাপুর, বাঘা ও মোহনপুরেও। মোহনপুরের মাছচাষি লিটন সরকার বলেন, প্রতিটি পুকুরে গড়ে ৩-৪ লাখ টাকা খরচ পড়ে। মাছ ধরার সময় আসতেই হঠাৎ ভাইরাসে মাছ মরতে শুরু করে। পুকুরে থাকা পুরনো মাছ তুলতে না পারায় এবার নতুন পোনা ফেলার মতো অবস্থাও নেই। এইভাবে বিনিয়োগ চক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরো মৎস্য অর্থনীতিই ক্ষতির মুখে পড়েছে।মাছচাষে সাধারণত প্রতিটি বিঘা জমিতে গড়ে ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়—খাদ্য, ওষুধ, পোনা ও পরিচর্যার খরচ মিলিয়ে। একটি মাঝারি আকারের পুকুরে বছরে দুইবার মাছ তোলা যায়। রাজশাহীতে সরকারি হিসাবে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে মাছচাষ হয়, যার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ জমিতেই ভাইরাসে মাছ মারা গেছে বলে দাবি চাষিদের। গড়ে প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার মাছ উৎপাদন হয়। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে প্রায় ৩০০-৪০০ কোটি টাকার উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।রাজশাহীর মৎস্য সমবায় সংগঠনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাদের প্রাথমিক হিসাব বলছে, রাজশাহীতে ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ কোটি টাকার মতো মাছ মারা গেছে। এর বাইরে অনেক চাষি আছেন যারা এখনো ক্ষতির পরিমাণ বলতে পারছেন না।রাজশাহীর মাছ উৎপাদন একটি চেইন ভিত্তিক অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে যেখানে পোনা বিক্রেতা, খাদ্য সরবরাহকারী, ওষুধ কোম্পানি, জাল ও পাম্প ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা এমনকি রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ব্যবসার সঙ্গেও এই খাত জড়িত।দুর্গাপুরের পোনা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, এবার চাষিরা পোনা নিচ্ছে না। যাদের আগে বুকিং ছিল তারাও পিছিয়ে গেছে। আমার মতো অন্তত ৩০ জন পোনা ব্যবসায়ী এখন অচল হয়ে পড়েছি।একই অভিযোগ মাছের খাদ্য সরবরাহকারী, ট্রাকচালক ও খালি জাল তৈরি ও মেরামতকারীদেরও। চাষিরা সাধারণত এনজিও ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মাছচাষ শুরু করেন। এই মৌসুমে মাছ তুলতে না পারলে তারা সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।দুর্গাপুরের মাড়িয়া বিলে চাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লাখ টাকা খরচ করেছি শুধু মাছ বাঁচাতে—ওষুধ কিনে, পানি পরিষ্কার করে। এরপরও কমপক্ষে ৪ লাখ টাকার মাছ মরে গেছে। আমার এনজিওর ঋণ এখন পরিশোধ করতে পারছি না। চাষিরা বলছেন, যদি সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রণোদনা না আসে, তবে আগামী মৌসুমে অনেকেই মাছচাষ ছেড়ে দেবেন।মৎস্য অধিদপ্তরের সদ্য অবসরে যাওয়া বিভাগীয় উপপরিচালক আব্দুল ওহাব জানান, আমাদের কাছে কোনো ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য নেই। খরায় পুকুরে পানি কমে যাওয়ার ফলে অক্সিজেন ঘাটতিতেই মাছ মারা যেতে পারে।তবে চাষিদের অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, শীত শেষে হঠাৎ করেই মাছের শরীরে লাল দাগ, পেট ফোলা, নাভি বড় হয়ে যাওয়া, পাখনা ঘোলা হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণ অক্সিজেন ঘাটতির লক্ষণ নয়। বিলের পরিবেশ ও পানির গুণমান পরীক্ষা না করেই এমন মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাষিরা।রাজশাহীর মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকারি জরুরি তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রণোদনা দিতে হবে। ক্ষতিকর ভাইরাস শনাক্তে জরুরি গবেষণা ও পরীক্ষাগার গড়ে তুলতে হবে। জেলাভিত্তিক বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে পরামর্শ দেওয়া জরুরি। সহজ শর্তে নতুন ঋণ এবং পুরাতন ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখতে হবে।বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে সমাধান না হলে রাজশাহীর মাছচাষে যে গতি তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে। এসআর

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
২৫ হাজার চাকরি বাতিল, সুদসহ ৮ বছরের বেতন ফেরতের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
২৫ হাজার চাকরি বাতিল, সুদসহ ৮ বছরের বেতন ফেরতের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের Read more

বগুড়ায় আবারও শেখ হাসিনা-ওবায়দুল কাদেরের নামে হত্যা মামলা
বগুড়ায় আবারও শেখ হাসিনা-ওবায়দুল কাদেরের নামে হত্যা মামলা

বগুড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে হুকুমের আসামি করে আরও একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ৮২ Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন