বাংলা নববর্ষ—শুধু একটি তারিখ নয়, বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বাংলা ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম দিনটি হলো পহেলা বৈশাখ। দিনটিকে ঘিরে বর্ণিল আয়োজনের পাশাপাশি থাকে বাহারি খাবারের আয়োজন। পান্তা ইলিশ খাওয়াকে অনেকে আবার বাঙালিয়ানার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও ভাবতে পছন্দ করেন।বাঙালি ঠিক কত বছর আগে থেকে পান্তাভাত খায় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য চণ্ডীমঙ্গলে পাওয়া যায় পান্তার বর্ণনা। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ‘কালকেতুর ভোজন’ এ লিখেছেন, ‘মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে/এক শ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজাড়ে/চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ/ছয় হান্ডি মুসুরি সুপ মিশ্যা তথি লাউ।’বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন আঞ্চলিক অনুষ্ঠান ছিল আমানি। এখানে ‘আমানি’ হলো পান্তার জলীয় অংশ। এটি ছিল মূলত নতুন বর্ষে কৃষকের নিজস্ব আয়োজন। চৈত্র সংক্রান্তির শেষ বেলায় কৃষাণী হাঁড়িতে অপরিপক্ক চাল ছড়িয়ে কচি আমপাতার ডাল বসিয়ে দিতেন। নববর্ষের দিনে সূর্যোদয়ের আগে ঘর ঝাড়ু দিয়ে আমপাতা সহযোগে সেই পানি উঠোন ও ঘরে ছড়িয়ে দেন কৃষাণী। এরপর সেই ভেজানো ভাত পরিবারের সবাইকে খেতে দেওয়া হয়।মানি মূলত নববর্ষের আদি উপাদান। গত কয়েক শতবর্ষ ধরে পান্তা খেয়ে থাকে বাঙালি। বাঙালির সংস্কৃতির পুরোভাগই যেহেতু কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই পান্তাই ছিল সবচেয়ে সহজলভ্য। অন্যদিকে পান্তাভাত ছিল কৃষকের শারীরিক শক্তির উৎস। একসময় সূর্যোদয়ের পর পান্তা খেয়েই কৃষক মাঠে যেতেন। আর তাই তো পকেট হারকিউলিস তথা বিশ্বখ্যাত বাঙালি শরীরচর্চাবিদ মনোহর আইচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন পান্তা ভাতের জল, ‘তিন জোয়ানের বল।’ একইসঙ্গে নিজের শক্তির উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আমি দিনে চারবেলা পান্তাভাত খেতাম। বাংলার আবহমান গ্রাম বাংলায় পান্তা ভাত খাওয়া হতো নুন, কাঁচা লঙ্কা কিংবা বড়জোর পেঁয়াজ সহযোগে। পান্তা খাওয়ার বাসন হিসেবে দরিদ্র কৃষকের কাছে মাটির বাসন ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল না। কৃষক পান্তা খেত কচু পাতায় কিংবা কলা পাতায়।আর তাই তো ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন ‘আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিল পান্তাভাত’। ‘মান’ বলতে এখানে মানকচুর কথা বোঝানো হয়েছে। তথা মানকচুর পাতায় করে পান্তা ভাত বেড়ে খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কালের পরিবর্তনে পান্তার সঙ্গে একসময় যুক্ত হয় আলু ভর্তা কিংবা পোড়া বেগুন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরণের সহজলভ্য মাছ। এসব মাছের মধ্যে ছিল পুঁটি, কৈ, টাকি কিংবা ট্যাংরা, যা বিলে কিংবা পুকুরে সহজেই পাওয়া যায়।মাছে ভাতে বাঙালি হলেও ইলিশের সংযোগ তারও ঢের বাকি। কারণ ইলিশের দাম সবসময়ই ছিল খানিকটা চড়া। অন্যদিকে, ইলিশের দাম চড়া হওয়ায় তা গরম ভাতের সঙ্গে খেতেন গ্রামের মানুষ। পান্তার ভাগ্যে তা আর জুটতো না। অন্যদিকে, শহরের বিত্তবানদের কাছে পান্তাই ছিল আদতে গরীবের খাবার। ফলে ইলিশ তাদের কাছে সহজলভ্য হলেও পান্তা হেঁশেল ঘরের গণ্ডি পেরোতে পারতো না।ইলিশের সুখ্যাতি বরাবরই লিখিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য থেকে রাজনীতিতে বা আড্ডা মহলেও সেখানে পান্তার সুখ্যাতি ছিল না। ইলিশ যতখানি না সগৌরবে আলোচিত হত, সে তুলনায় পান্তা ছিল অনেকখানি অপাংক্তেয়। ফলে পান্তার সঙ্গে ইলিশের সংযোগ বাংলার ঘরে দেখা মিলেনি। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গত শতকের আশির দশকে ঢাকায়। ষাটের দশক থেকেই রমনার বটমূলে নববর্ষের প্রথম দিনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে থাকে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছিলো ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। দেশ স্বাধীনের পরও তা অবিচল থাকে।তবে ছায়ানটের মাধ্যমে কিন্তু পান্তা ইলিশ উঠে আসেনি। পান্তা ইলিশের প্রচলন শুরু হয়েছিলো ১৯৮০/৮১ সালের বর্ষবরণে। সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেবারের বর্ষবরণের কিছুদিন আগে সাংবাদিক বোরহানউদ্দিন আহমেদ প্রথম নববর্ষ উদযাপনের বিষয়ে ভাবতে গিয়ে পান্তা ইলিশ আয়োজনের প্রস্তাব দেন। অতঃপর তার বন্ধু, সহকর্মীরা জনপ্রতি চাঁদা তুলে পান্তা ইলিশের আয়োজন করেন। সে আয়োজন নিছক আড্ডাসুলভ হলেও পান্তা ইলিশ আয়োজনের কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ‘ছুটির ফান্দে’ খ্যাত গীতিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক শহিদুল হক খান রমনায় পান্তা ইলিশের আয়োজন করেন। একইসঙ্গে তিনি পান্তা ইলিশের পোস্টার এঁকেও পান্তা ইলিশকে জনপ্রিয় করে তুলেন।আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় রমনার বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সবার কাছেই আরাধ্য হয়ে উঠে। ফলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের পাশেই জমে উঠে পান্তা ইলিশ ছন্দ। সাংস্কৃতির কাছেই ব্যবসায়িক বুদ্ধি, দুয়ে মিলে পান্তা ইলিশের বিক্রি বাট্টা দেদারসে বাড়তে থাকে। সে বছরগুলোতে মাটির সানকিতে করে পান্তা ইলিশের সঙ্গে যোগ হয় নানা পদের ভর্তাও। এমন সময়ে কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী রমনা বটমূলে পান্তা ইলিশ বিক্রি শুরু করলে তা রীতিমতো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পান্তা ইলিশ তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কয়েক বছরের মধ্যে পান্তা ইলিশ দেশব্যাপী রীতিমতো শোরগোল ফেলে দেয়। অনেকের দৃষ্টিতে তখন পান্তা ইলিশ হয়ে দাঁড়ায় বাঙালিয়ানার অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রথম পর্যায়ে ইলিশ মাছ দুর্লভ না হওয়ায় পান্তা ইলিশ অনেকেরই সাধ্যের মধ্যেই ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ইলিশ হয়ে উঠে বহু আরাধ্যের বস্তু।জনপ্রিয়তার পালাবদলে নব্বইয়ের দশকে পান্তা ইলিশ হয়ে উঠে নববর্ষে বাংলাদেশিদের কাছে পরম আরাধ্য। কেবল ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোই নয়, জেলা শহরের অলিগলিতেও নববর্ষের দিনে পান্তা ইলিশের বিক্রি দেখা যেত। পান্তার জোগান না হয় হলো, কিন্তু ইলিশের জোগান তো সীমিত। প্রথম দিকে ইলিশের দাম বাড়লেও একপর্যায়ে ইলিশের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি ইলিশের জোগান দিতে রীতিমতো শুরু হয়ে জাটকা নিধন কর্মসূচী। ফলে সরকারকেও বাধ্য হয়ে দুই মাস নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি নিতে হয়। বর্তমানে ছোট ইলিশ মাছকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পদ্মা ও মেঘনা, কালাবদর, তেঁতুলিয়া নদীসহ দক্ষিণাঞ্চলে মাছের পাঁচ অভয়াশ্রমে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সরবরাহ তো আর পুরোপুরি বন্ধ থাকে না। তাই শহুরে পান্তা ইলিশ পরিবেশনে ইলিশের জোগান দিতে মাঘ মাস থেকেই ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা  হিমাগারের বরফে ইলিশ সংরক্ষণ শুরু হয়।এ প্রেক্ষিতে বলা যায় পান্তা ইলিশ যতখানি না বাঙালি সংস্কৃতির দাবীদার তারচেয়েও ব্যবসায়িক বুদ্ধির চমৎকৃত ফসল। তবে ব্যতিক্রম পান্তা। আবহমানকাল ধরে পান্তা বরাবরই ছিল বাঙালির দৈনন্দিন খাবার। এটি কখনোই নববর্ষের প্রথম দিনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে পান্তা ইলিশের প্রবর্তন হলেও নববর্ষের প্রথম দিনে আদিকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবার পরিবেশনের চল ছিল। এদিন বাঙালি চিরকালই ভালো খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতো।নববর্ষের আগের দিন তথা চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাঙালি খেতো শাক-ভাত তথা শাকান্ন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল বেলাতেই বাড়ির চারপাশের জলা, জংলা, ঝোপঝাড় থেকে শাক তুলে আনতো বাড়ির বউ-ঝিরা। মজার ব্যাপার হলো এই শাক হতে হত অনাবাদী। এমন চৌদ্দ পদের শাক দিয়েই চৈত্র সংক্রান্তির দিনের দুপুরের আহার হত। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে শাকান্ন ছাড়া বাড়িতে কোনো মাছ মাংসের পদ রান্না হত না।এইচএ

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
ভিকারুননিসার ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলই থাকছে
ভিকারুননিসার ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলই থাকছে

এর আগে, গত ১৯ মে ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল শুনানি শেষে ২১ মে রায়ের জন্য ধার্য Read more

চট্টগ্রামে বোলারদের রাজত্বে ব্যতিক্রম মুশফিক-মুমিনুল
চট্টগ্রামে বোলারদের রাজত্বে ব্যতিক্রম মুশফিক-মুমিনুল

প্রথম দিনে পড়েছে ১৪ উইকেট! তবে ভিন্ন দলের হয়ে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ও মুমিনুল হক।

বাংলাদেশ থেকে সরে গেল নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
বাংলাদেশ থেকে সরে গেল নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

শেষ পর্যন্ত শঙ্কাই সত্যি হলো। বাংলাদেশ থেকে সরে গেল নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-২০২৪।

অপ্রাপ্তবয়স্কদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনে কী ধরনের আইনি বাধা আছে?
অপ্রাপ্তবয়স্কদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনে কী ধরনের আইনি বাধা আছে?

"যদি মেয়েটি কোনো ধরনের সম্মতিও দেয়, সেই সম্মতি কোনো কাজে লাগে না। সে ১১ বছরের বাচ্চা, তার এখানে সম্মতি দেওয়ার Read more

মিয়ানমারে ২০২৫ সালে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা জান্তার
মিয়ানমারে ২০২৫ সালে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা জান্তার

মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং আগামী বছর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। 

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন