চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠা কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) আজ দেশের শিল্পায়ন ও রপ্তানি খাতের একটি অনন্য উদাহরণে পরিণত হয়েছে। যাত্রার শুরুতে যার স্বপ্ন দেখেছিলেন কোরিয়ান নাগরিক কিহাক সাং। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি, ৩৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হয়ে।১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হলেও ২০১১ সালে এই রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়। আজ ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এই জোনে গড়ে উঠেছে ৪৮টি নিজস্ব কারখানা, যুক্ত হয়েছে আমেরিকা ও জার্মানির আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান, এবং আরও বহু দেশের বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন সরেজমিনে পরিদর্শনে। শুধুমাত্র রপ্তানি নয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও কেইপিজেড একটি যুগান্তকারী উদাহরণ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে শ্রমিক সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৭০ হাজারে।কেইপিজেডের পেছনে যিনি মূল নায়ক, সেই কিহাক সাং ৭৮ বছর বয়সী এই শিল্পপতি আশির দশকে বাংলাদেশে পা রাখেন পোশাক শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দেখে। ১৯৮০ সালে তিনি কয়েকজন বাংলাদেশি অংশীদার নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড, যা পরবর্তীতে রূপ নেয় কেইপিজেড-এ। তার স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও নিষ্ঠার ফলেই আজ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর ২ হাজার ৪৯২ একর জায়গা রূপ নিয়েছে এক আধুনিক শিল্পনগরীতে।দেশীয় অর্থনীতিতে এই অভাবনীয় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কিহাক সাংকে দেওয়া হয়েছে সম্মানসূচক বাংলাদেশি নাগরিকত্ব (অনারারি সিটিজেনশিপ)। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই নাগরিকত্ব কেবল একজন বিদেশির সম্মান নয়, বরং এটিই হবে ভবিষ্যতের আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম অনুপ্রেরণা।কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের মতে, এই শিল্পনগরী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক স্বপ্নময় অবকাঠামো প্রস্তুত করেছে। কম মজুরি, দক্ষ জনশক্তি, সমৃদ্ধ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্দরসুবিধা এবং নিজস্ব ৪০ মেগাওয়াটের সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে বিনিয়োগ বান্ধব এক আদর্শ অঞ্চল। বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ১৬ মেগাওয়াট ব্যবহৃত হয় নিজস্ব কারখানায়, আর বাকিটা সরবরাহ করা হয় জাতীয় গ্রিডে।বর্তমানে আমেরিকান কোম্পানি ‘এমেরিকান এফার্ড’ সুতা উৎপাদনে, ‘পেঙার বাংলাদেশ’ এক্সেসরিজ উৎপাদনে এবং জার্মানির ‘এনজেল বার্ড’ গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগ করেছে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত বিনিয়োগ প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। সামনের দিনগুলোতে আইটি খাতে বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথাও জানানো হয়েছে। আগামী ২৫ এপ্রিল কেইপিজেডের টেকভিশন নামের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে আসছে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দল।কেইপিজেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান সময়ের কণ্ঠস্বর-কে জানান, “কিহাক সাং পুরো এলাকাটিকে স্বপ্নে মতো গড়ে তুলেছেন। আমরা শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্ব দিচ্ছি। ৮২৩ একর এলাকা সবুজায়নের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যাতে কর্মপরিবেশ থাকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর।”প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে এ পর্যন্ত রপ্তানি করেছে প্রায় দুই দশমিক পাঁচ শ’ বিলিয়ন ডলার। যার বেশির ভাগই এসেছে বিগত পাঁচ বছরে—যেখানে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে এই সময়কালে কেইপিজেড ও ইয়ংওয়ান পর পর তিন বছর দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।কেইপিজেডের সু কারখানায় কাজ করা শ্রমিক মাহমুদ আলী সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, কিহাক সাং আমাদের জন্য শুধুই একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি আমাদের জন্য একজন পথপ্রদর্শক। তার হাত ধরেই আমরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, কিহাক সাং এবং কেইপিজেড হয়ে উঠেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কোরিয়ান এই শিল্পপতির হাতে শুরু হওয়া একটি স্বপ্ন আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করছে একের পর এক সাফল্যের পালক। এই উদ্যোগ শুধু কর্ণফুলীকে নয়, বরং সমগ্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে এক উন্নয়নমুখী ভবিষ্যতের দিকে।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর