ঢাকার মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত যুবক মো. জুনায়েদ হোসেনের মৃত্যু একটি জাতীয় আলোড়ন তুলেছিল। তবে সেই শহীদকে ঘিরে এখন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় জমেছে রাজনৈতিক উত্তেজনা, দানা বাঁধছে শত্রুতার নতুন গল্প। একদিকে শহীদ পরিবার ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করছে, অন্যদিকে অভিযুক্তরা বলছেন তারা রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার।নিহত জুনায়েদ ছিলেন রাজনগর ইউনিয়নের বিলদেওনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। জীবিকার টানে ঢাকায় গিয়েছিলেন, কাজ করতেন মিরপুর-১০ নম্বরের একটি কম্পিউটার দোকানে। কিন্তু ১৯ জুলাইয়ের সেই উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে মিরপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। শহীদ জুনায়েদের মৃত্যুতে যেমন কান্না বয়ে গিয়েছিল তার গ্রামে, তেমনি তার নামেই দায়ের হওয়া হত্যা মামলা স্থানীয় রাজনীতিতে এনে দিয়েছে নতুন উত্তেজনা।মামলার আসামিদের তালিকায় রয়েছেন রাজনগর ইউপি চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবর, তার ভাই আলমগীর মাদবর, আত্মীয় ইকবাল, কামাল ও সোহেল মাদবরসহ আরও কয়েকজন। তাদের অভিযোগ এটি শুধুমাত্র একটি ষড়যন্ত্র, যেখানে জমি সংক্রান্ত পুরনো বিরোধ আর রাজনৈতিক মতভেদকে কাজে লাগিয়ে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের দিন, অর্থাৎ ৩১ মার্চ শহীদ জুনায়েদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কিন্তু মিলাদ শেষে পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবরের বাড়িসহ আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এমনকি শহীদের কবরেও নাকি হামলার চেষ্টা করা হয়।নিহত জুনায়েদের বাবা শাহ আলম ফরাজীর ভাষ্য, মিলাদের সময় কেউ পাশেই একটি চকলেট বোমা ফাটায়। এরপর চেয়ারম্যান আবু আলেম ও তার লোকজন আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। আমার ছেলের কবরেও ভাঙচুর করে।অন্যদিকে, চেয়ারম্যানপক্ষ নিজেদের নির্দোষ দাবি করে উল্টো নিজেদেরকেই হামলার শিকার হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান আবু আলেম বলেন, ঘটনার দিন আমি অন্য একটি সালিশ বৈঠকে ছিলাম। অথচ ষড়যন্ত্র করে আমাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।মামলার আরেক আসামি, জয়পুরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. কামাল হোসেন বলেন, ঘটনার সময় আমি জয়পুরহাটে কর্মরত ছিলাম। আমাদের পুরনো জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আমাকে এই মামলায় টেনে আনা হয়েছে।চেয়ারম্যানের মেয়ে, যিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দাবি করেন, ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অথচ আমাদেরকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এটা ঘৃণ্য অপপ্রচার।এই ঘটনার পেছনে রয়েছে আরও গভীর প্রেক্ষাপট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ, যেখানে নিহত হয়েছিলেন জুনায়েদ। সেই শহীদের স্মৃতিকে ঘিরে যখন সম্মান ও বিচার দাবি ওঠা উচিত ছিল, তখন সেটি পরিণত হয়েছে স্থানীয় শত্রুতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঘটনায়।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শরীয়তপুর জেলা আহ্বায়ক ইমরান আল নাজির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, “শহীদ জুনায়েদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু কুচক্রী মহল অস্থিরতা তৈরি করছে। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”ঘটনার বিষয়ে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।তবে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ঘটনা দুটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। যেন শহীদের পরিবার ন্যায়বিচার পায়। একজন শহীদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক শান্তি বিঘ্নিত হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে আমরা আদৌ শহীদের মর্যাদা দিতে পারছি তো? নাকি নিজেদের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করে চলেছি? শহীদ জুনায়েদ আজ একটি প্রতীক ন্যায়বিচারের, প্রতিবাদের, আবার একইসঙ্গে শঙ্কিত বাস্তবতার।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর