চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে রাতের আঁধারে তিন ট্রাক মুদি দোকানের মালামাল মজুদের ঘটনা নিয়ে এলাকাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা দাবি করছেন, এই পণ্যগুলো হয় সরকারি টিসিবি’র মালামাল, না হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বরাদ্দকৃত পণ্য, যা অবৈধভাবে সরিয়ে এনে বাজারে বিক্রির জন্য মজুদ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি পণ্য মজুদস্থানীয়রা জানান, গত ১৮ মার্চ মধ্যরাতে তিনটি ট্রাকে করে বিপুল পরিমাণ চাল, ডাল, হলুদ, রসুন, ছোলা, চিনি, খেসারি, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এনে কর্ণফুলীর দুটি গুদামে মজুদ করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রাক থেকে নামানো প্যাকেট ও বস্তাগুলো দেখে সরকারি পণ্য বলে মনে হয়। তবে গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা এসব পণ্যের বৈধতা প্রমাণে কোনো ক্রয় রশিদ দেখাতে পারেননি।স্থানীয় বাসিন্দা হাসান, কামাল ও রুবেল জানান, ‘এসব পণ্য যদি বৈধভাবে আনা হয়ে থাকে, তাহলে কেন রাতের আঁধারে গোপনে মজুদ করা হলো? পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, কারণ রাতেই থানায় খবর দেওয়া হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’পুলিশের রহস্যজনক নীরবতাপ্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, স্থানীয়রা রাতেই পুলিশকে খবর দিলেও থানা কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়নি। তবে তৎকালীন ডিউটি অফিসার এএসআই আব্দুল মালেক পিপিএম কিছুটা খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলেও থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এড়িয়ে যান বলে অভিযোগ উঠেছে।বিতর্কিত ডেলিভারি চালান ও মালিকানা দাবিট্রাকভর্তি পণ্যের মালিকানা দাবি করেন চরলক্ষ্যা এলাকার ইসমাইল নামের এক ব্যক্তি। তবে তিনি তাৎক্ষণিক কোনো বৈধ কাগজ দেখাতে পারেননি। দীর্ঘ বাদানুবাদের পর তিনি একটি ডেলিভারি চালান দেখান, যেখানে ‘পণ্যগৃহ ট্রেডিং’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ ছিল। কিন্তু চালানে ১৪ মার্চের তারিখ থাকলেও, স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মালামাল এসেছে ১৮ মার্চ!পরবর্তী ইসমাইল আরেকটি চালান রশিদ দেখান, যেখানে ১৬ মার্চের তারিখ ছিল এবং মালামাল ক্রেতার নামও ভিন্ন ছিল। প্রথম চালানে পণ্যের পরিমাণ ছিল ২৮২ বস্তা, আর দ্বিতীয় চালানে সেটি কমে ২৩৪ বস্তায় দাঁড়ায়। বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।রাজনৈতিক প্রভাব ও মালামাল সরিয়ে নেওয়াপ্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার রাতে রাজনৈতিক দলের কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে স্থানীয়দের বাঁধা দেন এবং দুই ট্রাক মালামাল দ্রুত সরিয়ে নেন। বাকি একটি ট্রাক চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের সৈন্যেরটেক এলাকার জালের একটি গুদামে মজুদ করা হয়।পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্য দুটি ট্রাকের মালামাল কর্ণফুলী থানার দেড় কিলোমিটার দূরত্বে আলী হোসেন মার্কেটের বুলবুলের একটি গুদামে মজুদ করা হয়। তবে ২২ মার্চ ভোরে দলীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে গোপনে এসব মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।কোস্টগার্ডের অভিযানে আরও এক ট্রলার পণ্য জব্দএদিকে, কর্ণফুলী নদীতে ১৯ মার্চ রাতে কোস্টগার্ডের অভিযানে আরও এক ট্রলার পণ্য জব্দ করা হয়। কোস্টগার্ড পূর্বজোন সূত্র জানায়, বাংলাবাজার ঘাট সংলগ্ন এলাকা থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত কাঠের বোট আটক করা হয়, যেখানে ৮ বস্তা পলিব্যাগ, ১০০ বস্তা ময়দা, ৪০ বস্তা পিয়াজ, ৩০ বস্তা রসুন, ৩০০ লিটার সয়াবিন তেলসহ প্রায় ১৭ লাখ টাকার মালামাল ছিল।মালিকানা যাচাই করতে কোস্টগার্ড মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাইলেও তারা তা দেখাতে ব্যর্থ হন। পরে এসব মালামালসহ বোট সদরঘাট নৌ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।আদালতে মালিকানা দাবি ও পুলিশের অবস্থানসদরঘাট নৌ থানা পুলিশ ২০ মার্চ আদালতে প্রতিবেদন পাঠালে এক ব্যবসায়ী এসব মালামালের বৈধ মালিকানা দাবি করেন। আদালত ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩৫ টাকার বন্ডে মালামাল জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেন।পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নএএসআই আব্দুল মালেক পিপিএম বলেন, ‘ঘটনার রাতে আমি ডিউটি অফিসার ছিলাম। আমাদের কাছে খবর এসেছিল,এ ধরনের একটি তথ্য। পরে মালিকপক্ষ একটি ডেলিভারি চালান দেখিয়েছে। কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় আমরা আর কোনো ব্যবস্থা নিইনি।’তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ২২ মার্চ সকাল ৬টার দিকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে আবারো গুদাম পরিদর্শন করেন, কিন্তু সেখানে কিছুই পাননি। কারণ এর আগেই মালামাল সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।কর্ণফুলী থানার ওসি শফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি, তবে কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’সদরঘাট নৌ পুলিশের ওসি মো. একরাম উল্লাহ বলেন, ‘কোস্টগার্ড আমাদের কাছে মালামাল হস্তান্তর করেছিল। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তা বৈধ মালিককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’সরকারি পণ্য পাচারের অভিযোগ: সত্য নাকি ব্যবসায়িক লেনদেন?ইসমাইল নামের ওই ব্যক্তি দাবি করেন, এসব পণ্য নোয়াখালীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য বরাদ্দকৃত ছিল, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বৈধভাবে ব্যবসা করছি, এটি কোনো টিসিবি বা চোরাই পণ্য নয়।’তবে রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি মালামাল মজুদ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, ডেলিভারি চালানের অসঙ্গতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে এই ঘটনার রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। স্থানীয়রা দাবি করছেন, দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করা হোক এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।এমআর

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন দুর্ভোগের এক স্থায়ী ঠিকানা!
ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন দুর্ভোগের এক স্থায়ী ঠিকানা!

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন এখন নিজেই এক অসুস্থ প্রতিষ্ঠান। বছরের পর বছর ধরে চলা অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জনবল Read more

দেশে একদিনে আরও ২৩৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত
দেশে একদিনে আরও ২৩৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত

সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। এদের Read more

গজারিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৫
গজারিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৫

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৫ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।শনিবার (১২ এপ্রিল) সকাল Read more

৬২০২ রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ
৬২০২ রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ

দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ২০২টি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। রবিবার (১৬ মার্চ) স্বরাষ্ট্র Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন