বরগুনার তালতলীতে টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘেঁষে ও পায়রা-বলেশ্বর-বিশখালী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় তেঁতুল বাড়িয়া এলাকায় জাহাজ পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) শিল্প মন্ত্রণালয়। এ শিল্প স্থাপন করা হলে সংরক্ষিত বন ধ্বংস ও নদ-নদীতে মৎস্যশূূন্য হওয়ার আশঙ্কা করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠন, জেলে ও স্থানীয় বাসিন্দারা।টেংরাগিরি বনাঞ্চলটি সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বনটি বরগুনার তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় বন স্থানীয়ভাবে ফাতরার বন নামে পরিচিত। আর এ বনেই গড়ে উঠেছে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য বনাঞ্চল সুরক্ষা। পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী দক্ষিণের এই তিন বড় নদ-নদী এখান থেকে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। আর এখানে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার ইলিশের প্রজনন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের নদ-নদীতে সাগর থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ৬০ ভাগ এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করে। এই বনাঞ্চলের ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দূরে গোড়াপদ্মা উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী এবং ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পাথরঘাটা উপজেলায় হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবস্থিত। বনাঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। মাছের প্রজনন ও চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ২০১৮ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্প স্থাপনের জায়গা নির্ধারণ করে তৎকালীন সরকার। এসময় শিল্পটি আমলাতান্তিক জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পরিবেশবান্ধব জাহাজ পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প’। এ শিল্পের নামের সাথে পরিবেশবান্ধব যুক্ত করা হলেও আসলে এটি পরিবেশের জন্য মারাক্তক ক্ষতিকর। জাহাজ ভাঙাগড়ার মতো এমন ভারী শিল্প হলে নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য। সেই সঙ্গে প্রজননক্ষেত্র আর অভ্যন্তরে প্রবেশের জায়গা হারিয়ে ফেলবে ইলিশসহ হাজারো প্রজাতির মাছ। ফলে মৎস্যশূন্য হবে পুরো দক্ষিণ অঞ্চল। বেকার হবে কয়েক লাখ মানুষ। টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলও পড়বে হুমকির মুখে। এছাড়াও এই এলাকার মানুষের কৃষি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কায় জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন জন্য জায়গা পরিবর্তনের দাবি তুলছেন এই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা।গত ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে উপজেলার নিশান বাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করার লক্ষ্যে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার উপর জনমত যাচাই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন (উৎপাদন ও প্রকৌশল) বিএসইসি এর উপসচিব ও পরিচালক ড. মোঃ বেলাল হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তর বরগুনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হায়াত মাহমুদ রাকিব। এসময় ব্যানারে বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মাদ মুজাহিদুল ইসলামের নাম থাকলেও তাঁকে সভায় উপস্থিত দেখা যায়নি। এসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু জাফর মোঃ ইলিয়াস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. সাদেকুর রহমান, উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমানসহ স্থানীয় গনমাধ্যম কর্মীরা। এটি জনমত যাচাই সভা হলেও জানেন না স্থানীয় বেশিরভাগ বাসিন্দারা। সভাটি শুরু করে মাঝামাঝি অবস্থানে গেলে স্থানীয় জেলে ও কৃষকরা এ শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে নানা ধরনের শ্লোগান দিয়ে সভা ত্যাগ করেন। এরপর সভা ত্যাগ করেন উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাগন। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের তোপের মুখে পড়ে তড়িঘড়ি করে সভাটি সমাপ্ত করেন বিএসইসি শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।তালতলী উপজেলা জেলে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম মাতুব্বর বলেন, এই এলাকার শতকরা ৮০ জন লোক জেলে অথবা মৎস্য পেশার সাথে জড়িত। জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন এলাকায় এমন ভারীশিল্প কারখানা নির্মাণ করা হলে মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে পুরো দক্ষিণ অঞ্চল। কর্মসংস্থান হারিয়ে মানবেতার জীবন-যাপন করতে হবে মৎস্য পেশার সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষের। তাই জেলেদের পক্ষ থেকে আমার জোর দাবি এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রকল্প যাতে স্থাপন না করা হয়। পরিবেশ দূষণ ও দেশের মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করে এমন শিল্প স্থাপন করা হয় তাহলে এলাকাবাসী ও জেলেদের পক্ষ থেকে বৃহত্তর কমর্সূচি ঘোষণা করা হবে।ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের (তালতলী-আমতলী) সমন্বয়ক আরিফুর রহমান বলেন, পায়রা-বলেশ্বর-বিশখালী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প হলে মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে দক্ষিণ অঞ্চল। অত্র এলাকায় জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব পড়বে। কাটা পড়বে বনের কয়েক হাজার গাছ। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। পরিবেশের ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন শিল্প স্থাপন করা হলে আমরা পরিবেশ কর্মীরা বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেব।তালতলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, সংরক্ষিত বনের আওতায় জাহাজ পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করার বিষয়ে পটুয়াখালী উপকূলীয় বন কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছি।তালতলী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, এ শিল্প স্থাপন করা হলে প্রাকৃতিক মৎস্য খাতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।তালতলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা বলেন, এ শিল্প স্থাপনের বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা লিখিতভাবে আপত্তি জানালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।এবিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার নাঈম ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব এম এ কামাল বিল্লাহ বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) হয়েছে। এখন এটা পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। অল্প দিনের মধ্যেই এটা নিয়ে সভা আছে। পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকায় এ ধরনের শিল্প কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ডিপিপি করার সময়ই তো এসব বিবেচনা করা হয়, আমি সেটি দেখিনি। তবে এখনো এটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, পরিকল্পনা কমিশনে এই প্রকল্পের ব্যাপার নিয়ে অনেক সভা হবে, বিনিয়োগের সময় এগুলো যাচাই করা হবে।এসআর

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
অসুস্থ শাহরুখ, যা জানালেন জুহি চাওলা
অসুস্থ শাহরুখ, যা জানালেন জুহি চাওলা

হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান।

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন