চট্টগ্রাম- একসময় যে নগরীর পরিচয় ছিল সমুদ্র, বন্দর আর ব্যবসার কেন্দ্রস্থল, সেই নগরী আজ ভয় আর আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন। প্রতিদিনের সূর্যোদয় যেন নতুন কোনো অপরাধের সাক্ষী হয়। দিনের আলোয় জমি দখল, খুনোখুনি আর রাতের আঁধারে মহাসড়কে ডাকাতির হাহাকার—সবকিছুই যেন এক অব্যক্ত আতঙ্কের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই অপরাধের জোয়ার রুখতে যে বাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর হওয়ার কথা, সেই পুলিশের ভূমিকা আজ চরম প্রশ্নবিদ্ধ।গভীর রাতে যখন নগরী ঘুমিয়ে থাকে, তখনই ডাকাত দল অস্ত্রের ঝনঝনানি তুলে নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি লুট করে। মহাসড়কের কালো পথ হয়ে ওঠে সর্বস্বান্ত যাত্রীদের আর্তনাদের মঞ্চ। গরুর খামার থেকে একে একে উধাও হয়ে যায় প্রাণিসম্পদ। শহরের অলিগলিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চলতে থাকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আর পুলিশের ভূমিকা? কখনো নিষ্ক্রিয়, কখনো বিতর্কিত, কখনো আবার অপরাধের সাথেই সম্পৃক্ত।চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। মহাসড়ক থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি পুলিশের নিজস্ব ফাঁড়িও সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ছে। চাঁদাবাজি, খুন, জমি দখল, ডাকাতি, পুলিশের ওপর হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অপরাধীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, পুলিশের সীমিত প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বাহিনীর ভেতর কিছু অসাধু সদস্যের জড়িত থাকার কারণে জনগণের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে।পুলিশের কাজ হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে দেখা যাচ্ছে, অপরাধীদের প্রতিরোধ করার বদলে পুলিশই হামলার শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং দায়িত্বহীনতাও অপরাধীদের উৎসাহিত করছে।চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। শুধু গাড়ি থামিয়ে লুটপাটই নয়, অস্ত্রের মুখে গরুর খামার লুটের ঘটনাও ঘটছে।১৪ জানুয়ারি রাতে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদে ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গরু লুট করে। পটিয়ায় এক খামার থেকে ডাকাতদল ১৯টি গরু লুট করে নিয়ে যায়। পতেঙ্গা, পাঁচলাইশ, বোয়ালখালী ও ফটিকছড়িতে একের পর এক গরু ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এবং সীতাকুণ্ডের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতদের তাণ্ডব প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।সাধারণ জনগণের অভিযোগ, থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ তৎপরতা দেখাচ্ছে না। তারা অভিযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু অপরাধীদের ধরতে আগেভাগে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। ফলে ডাকাতদল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।অপরাধীরা এখন এতটাই দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে, পুলিশের ওপর সরাসরি হামলা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ২১ নভেম্বর আকবরশাহ এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৫ আগস্ট আকবরশাহ থানার নাছিয়াঘোনায় পুলিশের ফাঁড়ি দখল করে সেখানে সন্ত্রাসীরা অফিস খুলে বসে। এবং ১৪ জানুয়ারি কাপ্তাই রাস্তার চেকপোস্টে তল্লাশি চালানোর সময় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে মারধর করা হয়।এই ঘটনা প্রমাণ করে, পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে এবং অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তারা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তোয়াক্কা করছে না।রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মিরসরাই বাণিজ্য মেলায় যুবদল কর্মী মুন্না খুন হন। ২ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডে শ্রমিক দল নেতা মীর আরমান হোসেনকে পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। এবং গতবছরের ২৯ আগস্ট অক্সিজেন কুয়াইশ এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁওয়ে টার্ফ দখল নিয়ে যুবদল কর্মী জুবায়ের উদ্দিন বাবুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার শমসের পাড়ায় ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন তাহসীনকে চাঁদার টাকা না দেওয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়।এসব ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা জনগণের মধ্যে আরও হতাশা সৃষ্টি করেছে।অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ পুলিশের ভেতর দুর্নীতি এবং কিছু অসাধু সদস্যের সরাসরি অপরাধে জড়িত থাকা। ১৭ জানুয়ারি চকবাজার থেকে এএসআই আলমগীর হোসেন ১৬০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার হন। ৫ ডিসেম্বর বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় ডাকাতির সময় ধরা পড়ে ছয় ডাকাত, যার মধ্যে ফারুক নামে এক পুলিশ এএসআই ছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর পুলিশের বরখাস্তকৃত কনস্টেবল শামীম ভূঁইয়া পুলিশের পরিচয় দিয়ে দেড় লাখ টাকা প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।পুলিশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে।এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, “সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পুলিশ সদস্যদের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও উঠছে, যা বাহিনীর শৃঙ্খলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”বিশেষজ্ঞদের মতে, “চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। পুলিশ যদি কার্যকর ভূমিকা না নেয়, তাহলে সাধারণ মানুষকেই প্রতিদিনের জীবনে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হবে। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমন করা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করাই একমাত্র পথ।”এফএস

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
বজ্রপাতে দুই জেলায় ৪ জনের মৃত্যু
বজ্রপাতে দুই জেলায় ৪ জনের মৃত্যু

বজ্রপাতে দুই জেলায় ৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে, ঝালকাঠিতে ৩ জন ও খুলনায় এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো Read more

নতুন সম্ভাবনা ও আশা নিয়ে শুরু হোক বাংলা নববর্ষ: পরিবেশমন্ত্রী
নতুন সম্ভাবনা ও আশা নিয়ে শুরু হোক বাংলা নববর্ষ: পরিবেশমন্ত্রী

সাবের চৌধুরী বলেন, অনেকের শ্রম, মেধা ও ত্যাগের বিনিময়ে একটি প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একুশে টেলিভিশন Read more

জেসি এবার বিশ্বকাপে
জেসি এবার বিশ্বকাপে

Source: রাইজিং বিডি

অগ্রণী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন
অগ্রণী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন

এ সময় অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদা বেগম, মহাব্যবস্থাপক, ঊর্ধ্বতন নির্বাহী, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন