চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগমকে মাত্র দুই মাস ১৭ দিন পর পুনরায় একই কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আগে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কী এমন জরুরি প্রয়োজন তৈরি হলো, যার ফলে তাকে দ্রুততার সঙ্গে ফিরিয়ে আনতে হলো? স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সচেতন মহল, অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন।মনোয়ারা বেগম মূলত স্বাস্থ্য সহকারী, তবে তিনি নিজ বেতনে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (স্যানিটারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বাজার তদারকির নামে চাঁদাবাজি, স্বাস্থ্য সনদ প্রদানের নামে ঘুষ নেওয়া, অভিযান পরিচালনার আগেই তথ্য ফাঁস করা, ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। তবুও তাকে ফেরানো হয়েছে, যা প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করছে।চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোছাম্মৎ জেবুন্নেসার চাহিদার ভিত্তিতেই তাকে আবারও পদায়ন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সম্মতিও ছিল। বিশেষ করে রমজান মাস উপলক্ষে তাকে কর্ণফুলীতে দরকার বলে জানানো হয়।’তবে প্রশ্ন থেকে যায়—রমজান উপলক্ষে একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের এমন বিশেষ প্রয়োজনীয়তা কেন তৈরি হলো? যদি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা এতই গুরুতর হয়ে থাকে, তবে অন্য দক্ষ ও নিরপেক্ষ কাউকে পদায়ন করা যেত না? কর্ণফুলীতে কি এমন কোনো সুবিধা আছে, যা তাকে বারবার ফিরে আসতে বাধ্য করছে?উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোছাম্মৎ জেবুন্নেসা বলেন, ‘মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো বলে শুনেছি, তবে সেই সময় তাকে মনিটরিং করার মতো কেউ ছিল না। এবার আমি নিজেই তাকে মনিটর করব, যাতে কোনো অনিয়ম করতে না পারেন।’তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আগেও যখন তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল, তখন কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? যদি তিনি সত্যিই অনিয়ম করে থাকেন, তাহলে প্রশাসন তাকে শাস্তি না দিয়ে বরং কেন পুনর্বহাল করল?অনুসন্ধানে জানা গেছে, মনোয়ারা বেগম কর্ণফুলীতে ফেরার জন্য একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এমনকি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টাও করা হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু আবারও তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। তাহলে কি প্রশাসনই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?”অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এসআইটি কোর্স পাস করা জুনিয়র স্বাস্থ্য সহকারীদের নিয়মবহির্ভূতভাবে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন করছে। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশ রয়েছে, এই ধরনের অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্পষ্টভাবে বলেছে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জন বারবার এসব নিয়ম ভঙ্গ করে যাচ্ছেন। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পূর্ববর্তী আদেশও মানা হয়নি।প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিভিল সার্জনের নির্দেশে মনোয়ারা বেগমকে কর্ণফুলী থেকে সরিয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মাজেদা বেগম। কিন্তু মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কেন তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো?এই পুনর্বহাল কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, নাকি এর পেছনে কোনো লেনদেন বা রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে? কর্ণফুলীতেই কেন তাকে বারবার রাখা হচ্ছে? তার ফিরে আসার পেছনে কি সত্যিই জনস্বার্থ জড়িত, নাকি ব্যক্তিস্বার্থ?এই প্রশ্নের জবাব জানতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।একজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে বারবার একই স্থানে বহাল রাখা শুধু নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নই নয়, এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনের অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি প্রশাসন সত্যিই স্বচ্ছ হতে চায়, তাহলে সুনির্দিষ্ট তদন্তের মাধ্যমে এ ধরনের পদায়ন হওয়া উচিত।জনগণ জানতে চায়, কর্ণফুলীতে এমন কী আছে, যা একজন কর্মকর্তাকে এতটা মরিয়া করে তোলে? প্রশাসন যদি এই প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারে, তবে জনমনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হবে।এমআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর