By: Daily Janakantha
‘বাংলাদেশীরা অর্থ লোভী, বোকাও!’
উপ-সম্পাদকীয়
23 Jun 2022
23 Jun 2022
Daily Janakantha
কে বা কারা বীর বাঙালীদের সম্পর্কে এরকম কঠোর মন্তব্য করেছে? নিশ্চয়ই পাঠকেরা ততটা খেয়াল করেননি ভিনদেশী, বিশেষত নাইজিরিয়ান প্রতারকচক্র বিমানবন্দরকেন্দ্রিক যে ‘উপহার প্রতারণা’র খেলা খেলে কিছুদিন আগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তাদের মন্তব্য এটি। তাদেরকে কয়েকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, ‘এত দেশ থাকতে তোমরা এই প্রতারণার কাজটি বাংলাদেশে কেন কর?’ প্রশ্নটি এমনই ছিল। এর উত্তরে প্রতারকচক্রের কয়েকজন বলে- ‘বাংলাদেশীরা অন্য দেশের মানুষের চাইতে অনেক বেশি মৎববফু, অর্থাৎ অর্থ লোভী এবং তারা বোকাও।’ প্রতারকচক্রকে বহু দেশ ঘুরে খুঁজে বের করতে হয়েছে তাদের প্রতারণার খেলাটি কোন্্ দেশের মানুষের সঙ্গে সফলতার সঙ্গে খেলা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এ মন্তব্যটি শোনামাত্র আমাদের মনে হয়েছিল আরে, এ নাইজিরিয়ান প্রতারক দল তো এ সময়ের বাঙালীর যথার্থ সংজ্ঞা আবিষ্কার করেছে। কি বুদ্ধিমান এ প্রতারক দল! অবশ্য বাঙালীর লোভ যে কত বিচিত্র এবং উচ্চমাত্রার তা তো প্রতিদিনের সংবাদপত্রে, চ্যানেলের খবর সূত্রে জনমানুষ জানতে পারছে। এর মধ্যে মফস্বলকেন্দ্রিক এমএলএম কোম্পানি এবং বিদেশে চাকরি বা নাগরিক করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রতারকচক্রকে তো আমরা দীর্ঘকাল যাবত চিনি। প্রথমোক্ত প্রতারকচক্র গ্রামের সাধারণ চতুর-লোভী দল, যারা এলাকার বোকা নারী-পুরুষের সঞ্চয়ের অর্থ অবিশ^াস্য হারে লাভ বা মুনাফা বা সুদ দেয়ার লোভ দেখিয়ে লুটে নেয় তাদের সঞ্চয়। যখন কয়েক কোটি টাকা তাদের হাতে জমা হয় তখন একদিন ঐ অফিসে তালা ঝুলিয়ে ফোনের সিম ফেলে নতুন সিম নিয়ে নতুন স্থানে এক বা একাধিক ধনী নতুন মানুষে পরিণত হয়। এদের মধ্যে যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তারা জেলে যায়। তবে তাদের কাছ থেকে গ্রামের গরিব, শ্রমজীবী, বোকা নারী, পুরুষ তাদের গচ্ছিত অর্থ কোনদিন ফেরত পেয়েছে এমন তথ্য শুনিনি। তরুণদের ইউরোপ-আমেরিকা পাঠানোর নামে দ্বিতীয় প্রতারক দল গ্রামের মানুষদের বড় অঙ্কের অর্থ নেয়। এই প্রতারক দলের হাতে তরুণদের বাবা-মায়েরা জায়গাজমি বিক্রি করে, বসতবাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখে অবিশ^াস্য বিশাল অঙ্কের অর্থ দিয়ে থাকে। তাদের আরও শর্ত থাকে যে, ইউরোপ-আমেরিকা পৌঁছালে আরও অর্থ দিতে হবে। ইতোমধ্যে জনগণ দেখেছে, অনেক তরুণের লিবিয়ার বন্দী শিবিরে খাদ্যাভাবে এবং প্রতারক ও তাদের সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে। অনেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবির ফলে প্রাণ হারিয়েছে। এর আগে আমরা ইউরোপ-থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশী ভাগ্যান্বেষীদের গোপন যাত্রাপথে খাদ্য ও পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। অনেক কঙ্কালসার মানুষের সংবাদ জেনেছি। এসব বেআইনী যাত্রার সঙ্গে থাইল্যান্ডের উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তার এবং আমাদের স্বদেশী প্রতারকচক্রের দালালদের যোগসাজশের তথ্যও জেনেছি। বন্দী শিবিরে তরুণদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের ক্রন্দন টেলিফোনে বাবা-মাকে শুনিয়ে এই অমানুষ বাঙালীদের বাড়তি অর্থ চাইতেও দেখেছি। এদের মতো সাধারণ, প্রায় নিরক্ষর প্রতারকদের মধ্যে এসব কর্মকা- সীমিত থাকলেও হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই নাইজিরিয়ান প্রতারকরা বাঙালীদের সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করেছে। শহরের উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ পদে চাকরি করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যুবক, ডেসটিনি, ইভ্যালি, পিপলস লিজিং ইত্যাদি প্রতারণামূলক এমএলএম ধরনের কর্মকা-ে যোগ দেয় কেন? লোভই এদের প্রধান নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামক।
আর যারা ব্যাংক বা ব্যাংক নয় এমন ঋণদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে, মানে আমাদের সাধারণের জমা রাখা অর্থ লুট করে যারা ফেরত দেয় না তারা তো মহালোভী বা মৎবধঃ মৎববফু সধহ, তাই না? তা না হলে পি.কে হালদার বা এস. কে. সিনহা এবং আরও বহু মহারথী ঋণ করে ঘি খাওয়া ব্যক্তিরা বিদেশে ‘বেগমপাড়া’ গড়ে তুলে অর্থলোভ থেকেই। পত্রিকা সূত্রে মাঝে মাঝে সুইস্্ ব্যাংকে বিভিন্ন দেশের ধনী ব্যক্তিদের বিপুল অর্থের গোপন এ্যাকাউন্টের কথা ওঠে। এক সময় লিখেছিলাম- এরা কেমন গণতান্ত্রিক দেশ যে, বিভিন্ন দেশের ব্যক্তিদের লুটের অর্থ, কালো টাকা তাদের দেশে গচ্ছিত রেখে লুটেরাদের উৎসাহিত করে? এটা তো এক ধরনের উপনিবেশবাদী চরিত্র। এখন শুনছি অফশোর ব্যাংকে আয়কর না দেয়া অর্থ বিনিয়োগ করে পৃথিবীর ধনীরা! এমনকি ব্রিটেনের রানীরও এমন বিনিয়োগ থাকার কথা উঠেছে। বুঝি না এসবের কি দরকার আছে। যারা পারিবারিক সম্পত্তি দ্বারা আগে থেকেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক? ওরাও লোভী। তবে আমাদের মতো এত বেশি লোভী মানুষ সম্ভবত অন্য দেশে কম আছে। নাইজিরিয়ানরা তো কম দেশ খোঁজেনি।
এই তো কিছুদিন আগের কথা। আমাদের তরুণ, তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির মতো তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতারণার ফাঁদ খুলে কোম্পানি তৈরি করে ক্রেতাদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়ে বড় দুর্নাম কিনল! আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে, যারা বড় গলায় বলতাম- আমাদের তরুণ প্রজন্ম আমাদের ‘বেগমপাড়া’ বা ‘সেকেন্ড হোম’ করা ‘সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা’ আগের প্রজন্মের চাইতে অনেক সৎ। মাত্রই জানলাম- সুইস ব্যাংক জানাচ্ছে বাংলাদেশীদের সুইস ব্যাংকে রাখা টাকা গত এক বছরে ৫৫% বৃদ্ধি পেয়েছে! গত এক বছরে প্রযুক্তি খাতে দুর্নীতি ব্যাপক আকারে হয়েছে। তাছাড়াও যদি প্রশাসক-আমলারা ‘বেগমপাড়া’, ‘সেকেন্ড হোম’, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কানাডায় স্থায়ী বসতি গড়ে, তাহলে তারাও অবসরের পর সুইস ব্যাংকে বাড়তি অর্থ পাঠাতে পারে। ব্যবসায়ীদের আন্ডার ও ওভার-ইনভয়েসিং বন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধরা যেতে পারে কিনা জানা নেই। তবে আসল কথায় আসা যাক। বাংলাদেশীরা খুবই মৎববফু- এটা বহুভাবে প্রমাণ হয়েছে।
এটা তো ঠিক, আমাদের যে কোন পর্যায়ের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরও বিমানবন্দরে তাকে কেউ আগে না জানিয়ে কোন মহামূল্যবান উপহার বা ডলারভর্তি কার্টন পাঠিয়েছে- একথা অচেনা ব্যক্তির ফোনে জেনে বিশ^াস করার কারণ কি? প্রথমেই তো তিনি প্রশ্ন তুলবেনÑ ‘কে পাঠিয়েছে, তার নাম, ঠিকানা কি, জানাও।’ এ প্রশ্ন ওঠাও উচিত- ‘আমাকে না জানিয়ে কে আমাকে মূল্যবান উপহার পাঠাবে? ডলারভর্তি কার্টন? এটা তো অবিশ^াস্য। পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি আমাকে ‘ডলারভর্তি কার্টন কেন পাঠাবে? এসব ঘটনা থেকে একটা ভয়ঙ্কর লোভে আক্রান্ত নারী-পুরুষের চেহারাই ফুটে ওঠে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এরা ঐ তথ্য বিশ^াস করে লাখ লাখ টাকা এই প্রতারকদের নানারকম সন্দেহজনক দাবি পূরণেও দিয়েছে।
শেষ কথা, বিদেশে যারা অর্থ নিয়ে গেছে সেগুলো আমাদের টাকা, দেশের টাকা, জনগণের টাকা। ঐ লুটে নেয়া অর্থ যদি দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে তো লুট করে নিয়ে যাওয়া অর্থ ফিরে পাব। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে হ্যাক হওয়া অর্থ ফিরে আনা দরকার। আমাদের তো মনে হয় সুইস ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ পাচারকারীদের নাম, পরিচয়, অর্থের পরিমাণ জানার চেষ্টা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশ করা উচিত। তারপর দেশের সে অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার যত রকম চেষ্টা আছে, মানিলন্ডারিং আইনসহ সেসব চেষ্টাও করা উচিত। টাকা না ফিরিয়ে আনার চেয়ে ফিরিয়ে আনাই তো দেশের স্বার্থ। আমরা যদি পাচার করা সম্পদ, অর্থ ফিরিয়ে আনার কোন চেষ্টাই না করি তাহলে তো পাচারকারীরা উৎসাহিত হয়ে আরও অর্থ পাচার করবে বিদেশে। বাড়িতে ডাকাত পড়লে সোনাদানা, অর্থ লুট করলে আমরা পুলিশের সাহায্যে আমাদের লুট হওয়া সোনাদানা, অর্থ ফিরে পাবার চেষ্টা করব না? ব্যাংক বা প্রকল্পের অর্থ তো জনগণের অর্থ। সে অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অনৈতিক হবে কেন? লুটেরাই তো অনৈতিক কাজ করেছে। তাকে মারধর করা যাচ্ছে না। জরিমানা করা তো যাবে। ভারত পি.কে হালদারের লুট করা অর্থ ফেরত দেবে বলেছে। এসব ভাল নয় কি? পাচার করা অর্থ আনা প্রসঙ্গে নৈতিকতা-অনৈতিকতার কথা উঠেছে। পাচার করা, লুট হওয়া অর্থ ভাল ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেশে আনাটা অনৈতিক নয় বলেই মনে করি। কিছুই না আনার চাইতে কিছু আনতে পারাটা দেশের জন্য অনেক বড় স্বার্থরক্ষার কাজ।
আমাদের চলতি জীবনের একটি কঠিন সত্য অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এটি নিয়ে সেদিন কর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি একটি দরখাস্ত দিতে বললেন। যেখানে আমার চাকরি জীবনের শুরু থেকে আয়কর রিটার্ন দেয়ার, ফ্ল্যাট ক্রয়ের যাবতীয় বিষয় উল্লেখ করতে বলেন। পত্রে আমি লিখেছি- ‘ফ্ল্যাটের দলিলে যে দাম লেখা আছে সে মূল্যের চাইতে আমরা অনেক বেশি দামে ফ্ল্যাট কিনেছি।’ কর কর্মকর্তা হেসে বললেন, ‘আপনি রিটার্নটা দিয়ে দিন।’ এখন এটা সত্য যে, ফ্ল্যাট বিক্রেতা ঐ কালো টাকা গ্রহণ করেছে আর কম মূল্যের রেজিস্ট্রেশন ফি-এর টাকা সরকার পেয়েছে। ক্রেতা এ কালো টাকা লাভ করে না। একই কথা খাটে জমির ক্রেতা ও বিক্রেতা যখন কেনা-বেচা করে থাকে। আমার মনে হয় এই জমি, ফ্ল্যাট কেনা-বেচার দুষ্টচক্রটি ভাঙবার সময় এসেছে। এটি ভাঙলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছাব। আমাদের চরিত্রের অর্থলোভ হ্রাস পাবে। প্রতারণার ফাঁদে পা দেব না। আরও একটু চরিত্রবান হব। তাছাড়াও কর রেয়াতের সীমা পাঁচ লাখ টাকা না করলে ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারবে না। ধনীদের কর হার আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বিজিএমই-এর ব্যবসায়ীরা ১% করও দিতে অসম্মত বলে জানতে পারছি। ধনীরা বেশি কর দিলে টাকা পাচারও কম হবে বলেই আশা করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ