By: Daily Janakantha
বন্যায় মানবিক বাংলাদেশ
চতুরঙ্গ
23 Jun 2022
23 Jun 2022
Daily Janakantha
করোনা শুরুর মুহূর্তে মানুষের মধ্যে ভয় ভীতির অস্তিত্ব তেমন একটা দেখা যায়নি। কিন্তু প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম হলেও এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল প্রিয় স্বদেশ। কি একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে দাফন করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিত। একদল স্বেচ্ছাসেবক জীবনকে তুচ্ছ করে করোনায় মৃতদের দাফন করার ঝুঁকি নিয়েছিল। মানুষের মৃত্যুর মিছিল পুরো বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করেছিল। এ ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির ফলশ্রুতি কখনই বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়নি। তথাপি বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে। সরকার পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা আমদানি করতে সক্ষম হয়।
করোনার সময় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বোধোদয় হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাসের ফুলঝুড়ি দেখা গেছে এ মর্মে- এ যাত্রায় বেঁচে গেলে ভবিষ্যতে কেউ কোন ধরনের খারাপ কাজে সম্পৃক্ত হবে না, সৃষ্টিকর্তার নিকট মানুষের ফরিয়াদ সকলেরই নজর কেড়েছে। করোনাকালীন যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে তাদেরকে বাহবা দিতেও আমাদের মধ্যে কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়নি। অর্থাৎ একটি মানবিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্দিকে এবং আশা করা হয়েছিল ধারাটি অব্যাহত থাকবে। অন্যের বিপদে এগিয়ে এসে মানবতার প্রতীক হয়ে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীকে আমরা লড়তে দেখেছি। মানুষেরও ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল এবং এ পরিবর্তন ধরে রাখতে মানুষ বদ্ধপরিকর ছিল। করোনাও শেষ হয়েছে, আমরাও আগের রূপে ফিরে এসেছি। যে যেভাবে পারছে অনিয়ম করছে, সুযোগ পেলেই অপরাধ করছে। অর্থাৎ করোনার শিক্ষাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু করোনার শিক্ষাকে ধরে রাখা উচিত ছিল প্রত্যেকের।
মাত্র কয়েকদিনের অতিবৃষ্টিতে এবং পাহাড়ের ঢল নেমে আসায় সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনাতে ব্যাপকহারে বন্যা দেখা দেয়। এ বন্যায় মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, ঘরবাড়িহীন মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্যশস্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে বন্যার্তদের মাঝে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বন্যাপীড়িত মানুষদের। এ ক্ষতি পুষিয়ে জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে ফিরে আসতে লম্বা সময়ের প্রয়োজন। এখন বরং মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই মূল চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে এবং বিভিন্ন ইউনিট উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টাও করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বন্যার্তদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে, ব্যক্তিবিশেষে মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সাহায্য প্রদান করছেন অনেকে। এ ধরনের উদ্যোগ হয়ত সাময়িক বিপদে উতরে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে কোন ধরনের পরিবর্তন আনয়নে সহায়ক হবে না। আর সেজন্যই দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের জন্য আমাদের পরিকল্পিত রূপকল্প ও অভিলক্ষ্যের প্রয়োজন রয়েছে।
তাহলে মূল কাজ হচ্ছে সত্যানুসন্ধান করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু প্রকৃত কাজটিই আমরা করতে পারছি না। শুধু ধামাচাপা দিয়েই যেন কার্যোদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। এ ধামাচাপার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর নাব্য সঙ্কট নিয়ে আলোচনা হয়, সঙ্কট প্রতিরোধে ফর্মূলা প্রদান করা হয়। কিন্তু কার্যত বাস্তবায়ন হয় না কিছুই। হয়ত পলিসি লেভেলে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়; কিন্তু বাস্তবায়নে কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়। দেশব্যাপী নদীগুলো দখলের মহোৎসব আমরা দেখতে পাই; কিন্তু অধিকাংশের মাঝে কোন ধরনের ভ্রƒক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ায় যৎসামান্য মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং এক সময় প্রতিবাদকারীদের নানাভাবে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কেননা, যারা দখল প্রক্রিয়ায় থাকছেন তারা সাধারণত বেশ প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। এটি একটি বিশাল প্রক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাঘববোয়ালরা জড়িত থাকে। না হলে খাল-নদী ভরাট করার দুঃসাহস চক্রটি কোনভাবেই করতে পারবে না। সরকারী সম্পত্তি হরিলুট করার পাঁয়তারায় একটি চক্র সর্বদা ব্যস্ত থাকে।
কোন মানুষ যখন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পেশাগত মর্যাদা ও প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে কোন ধরনের অপরাধ করে থাকে কিংবা অপরাধ করতে কোন পক্ষ বা গোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করে থাকে, সেসব অপরাধ হোয়াইট কলার অপরাধ (ডযরঃব ঈড়ষষধৎ ঈৎরসব) নামে পরিচিত। এ ধরনের অপরাধীরা কিন্তু নিজস্ব পরিচয়ের আড়ালে অপকর্মের রাজত্ব করে চলছে। এ শ্রেণীটি অর্থ পাচার (গড়হবু খধঁহফবৎরহম) ও মানব পাচারের (ঐঁসধহ ঞৎধভভরপশরহম) সঙ্গেও জড়িত। এদেরকে চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। না হলে এক সময় বাংলাদেশকেও অতি/অনাবৃষ্টির পানির মতো অঝোরে কান্না করতে হবে। বৃষ্টি আমাদের নিকট পরম পার্থিব বিষয়। বৃষ্টির আকাক্সক্ষায় আমরা দিন গণনা করি এবং বৃষ্টি এলে পরম প্রশান্তি অনুভব করি। কিন্তু এ বৃষ্টি যখন অতিবৃষ্টিতে রূপ নেয় তখন আমাদের যন্ত্রণার সীমা থাকে না। কেননা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো জায়গা প্রতিনিয়ত আমরা সঙ্কুচিত করে ফেলছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যারাই এ ধরনের অপকর্মকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তারা প্রত্যেকেই কিন্তু হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। অবশ্য এদেরকে মোকাবেলা করাটাও অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে। কেননা, এরা স্ব স্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং প্রভাবশালী। হলফ করে বলতে পারি এখনও অনেক হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল আমাদের চোখের সামনে বেশ ঐশ্বর্যের সঙ্গে বসবাস করছে। তাদের চরিত্র এখনও আমাদের নিকট অনাবিষ্কৃত। এ শ্রেণীর মানুষ সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার চেষ্টা করে থাকে, প্রকারান্তরে সরকারের ক্ষতি করে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সরকারকে। নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রভাব খাটিয়ে সরকারী খাল বন্ধ করার নজিরও রয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করে টিকতে পারে না। যারা সামনে থেকে প্রতিবাদ করে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে স্তব্ধ করে দেয়া হয় চিরদিনের জন্য। তাছাড়া সৎ সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করার মানুষও প্রতিনিয়ত কমে আসছে। দেখা গেছে সরকারী খাল বন্ধ করে ভিন্ন দিক দিয়ে জোর খাটিয়ে নতুন পানি চলাচলের লাইন তৈরি করা হয়। এতে করে সাধারণ কৃষকের হাজার হাজার একর ধানের খেত নষ্ট হয়ে যায়, ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ জনগণকে। একজনের সুবিধার জন্য শত শত মানুষকে অসুবিধায় ফেলার নজির দেখা যায় সর্বত্র। এই একজনের সুবিধা প্রণয়ন কিংবা বাস্তবায়নে যে বা যারাই ভূমিকা রাখুক না কেন প্রত্যেকেই বিভিন্ন উপায়ে দোষী। অনিয়মের মাধ্যমেই অধিকাংশের ক্ষতি সাধন করা হয়। নিয়মমাফিক সবকিছু পরিচালিত হলে অধিকাংশ মানুষই উপকৃত হয় এ বোধশক্তি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি যাচাই-বাছাই করে অগ্রগামী হওয়া ব্যতিরেকে বৃষ্টির কান্নার ন্যায় আমাদের কান্না প্রত্যহ দীর্ঘায়িত হবে।
বৃষ্টির অবারিত ধারা যখন আমাদের সহ্যের বাইরে চলে যায় তখনই সেটি বৃষ্টির কান্না হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের খাল, নদী, জলাধার যেভাবে যত্রতত্র ভরাট করে ফেলা হচ্ছে সেসব কিন্তু উন্নয়নের পরিবর্তে কান্নায় পরিণত হবে। কেননা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে সুষম উন্নয়ন অসম্ভব। ব্যবস্থাপনা সঠিক না রেখে উন্নয়ন হলেও সেটি এক সময় শাপেবর হয়ে ওঠে এবং এসব প্রমাণিত সত্য। কাজেই রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষীদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুষ্কৃতকারী যেই হোক না কেন, যে দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক না কেন অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের মুখোশ সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রকে আগে বাঁচাতে হবে। রাষ্ট্র যদি অস্থিতিশীল হয়ে যায় তাহলে আমরা কেউই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারব না। সে কারণেই আনুষ্ঠানিকভাবে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সাম্প্রতিক সময় চলা বন্যায় দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে সেটির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশকে যথেষ্ট বেগ পোহাতে হবে। পরবর্তীতে যেন এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্যই সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, নদী, খাল, নালা, প্রাকৃতিক জলাধার যেভাবে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে প্রতি বছর এর থেকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে খাল, নালা, নদী দখলদারমুক্ত করতে হবে। নদীগুলোকে প্রাণ দিতে হবে, নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে। নদীগুলোতে জমাট বাঁধা আস্তরণকে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। নদীশাসনে সরকার যথেষ্ট পরিমাণে বরাদ্দ প্রদান করে থাকে; কিন্তু তদারকির অভাবে কাজের গুণগতমান ও অগ্রগতি অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। কাজেই এ সকল বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য ফলাও করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যেতে পারে এ মর্মে- নদীশাসনের টেন্ডার হয়েছে এ ধরনের শর্তে এবং যে কোন নাগরিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের নিকট এ ব্যাপারে জবাবদিহিতার অনুশীলন করতে পারে।
কাজেই ভবিষ্যতে আমরা বৃষ্টির ক্রন্দনের ন্যায় বাংলার মানুষের ক্রন্দন দেখতে চাই না। বৃষ্টির ক্রন্দনকে যেন আমরা প্রতিকারে নিতে পারি সেজন্য আমাদের প্রাকৃতিক জলাধারগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যত্রতত্র স্থাপনা ও ইমারত নির্মাণে বাধা প্রদান করতে হবে। পরিকল্পিত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে বৃষ্টির কান্নার বিরূপ পরিস্থিতিকে কোনভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। ক্রিমিনালদের প্রতিহত করার জন্য উদাত্তচিত্তে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্মিলিত উপায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং বানভাসি মানুষের পাশে এ মুহূর্তে সর্বোতভাবে সক্ষমতা অনুযায়ী সকলেরই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। পরিশেষে হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এটা সত্য; কিন্তু সরকার যদি এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণ এর সুফল ভোগ করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ