By: Daily Janakantha
পাহাড়ী ঢলে ভাসতে ভাসতে প্রাণে বেঁচে গেলেন ষাটোর্ধ প্রভাতী
শেষের পাতা
22 Jun 2022
22 Jun 2022
Daily Janakantha
সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা ॥ পাহাড়ী ঢলে ভেসে যাওয়ার পর প্রায় ১২ঘণ্টা একটি বাঁশে ঝুলে থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছেন প্রভাতী হাজং নামের এক আদিবাসী নারী। শুধু তিনিই নন, একই রকমভাবে বেঁচে গেছেন তার স্বামীসহ হাজং পরিবারটির আরও চার সদস্য। কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের ধারাপাড়া গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী এ নারী জনকণ্ঠ প্রতিনিধির কাছে বর্ণনা করেছেন সেই ভয়াল রাতের দুঃসহ স্মৃতি। যা রীতিমতো অবিশ^াস্য মনে হতে পারে অনেকের কাছে।
প্রভাতী হাজং ধারাপাড়া গ্রামের যোগেন্দ্র হাজংয়ের স্ত্রী। একই পরিবারের বেঁচে যাওয়া অপর চারজন হচ্ছেন- তার স্বামী যোগেন্দ্র, ছেলে বিপ্লব হাজং, ছেলের বউ ঝটিকা হাজং ও দুই বছর বয়সী নাতনি শ্রদ্ধামণি হাজং। তাদের বাড়িটি ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।
প্রভাতী জানান, গেল বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে তারা খাবারদাবার খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন। রাত একটার দিকে হঠাৎ ঘরেদোরে পাহাড়ি ঢল আসার শব্দে জেগে ওঠেন। দেখতে পান মুহূর্তের মধ্যে ঘরে অথৈ পানি। পানির তোরে ঘরের বেড়া পর্যন্ত ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই বসে না থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢলের পানি মাড়িয়ে কিছুটা দূরে অবস্থিত রামনাথপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা।
কিন্তু বিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকা একটি সেতুর এ্যাপ্রোচের মাটি পাহাড়ী ঢলের তোরে সরে গিয়েছিল। সেখানে পা দিতেই অথৈ পানির ¯্রােতে ভেসে যান তারা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন একেকজন। প্রভাতীর স্বামী যোগেন্দ্র হাজং একটি বাঁশের খুঁটি ধরে এবং তার ছেলে বিপ্লব হাজং ধারাপাড়া সেতুর কাছে একটি গাছ ধরে রেখে প্রাণ বাঁচান। তাদের ছেলের বউ ঝটিকা হাজং ও তার কোলে থাকা শিশু শ্রদ্ধামণি স্রোতের সঙ্গে ভেসে হাবুডুবু খেতে খেতে চলে যান বেশ দূরে অবস্থিত জনৈক সোবহান মিয়ার বাড়ির কাছে। পরে তার চিৎকারে সোবহান মিয়ার পরিবারের লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করেন। পাহাড়ী ঢলের পানি নাকেমুখে ঢুকে শিশু শ্রদ্ধামণির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে ওই বাড়ির লোকজন পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করেন। এতে শ্রদ্ধামণিও বেঁচে যান।
ওদিকে পাহাড়ী ঢলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রভাতী হাজং চলে যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সন্তুর ভিটা নামে একটি নির্জন জায়গায়। এ সময় দৈবক্রমে একটা বাঁশঝাড় থেকে পানির ওপর নুয়ে থাকা একটি বাঁশের নাগাল পান তিনি। ওই বাঁশঝাড়টিও ছিল পানিতে নিমজ্জিত। নিরূপায়ে পরদিন বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই বাঁশেই ঝুলে থাকেন প্রভাতী হাজং। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারছিলেন না। জনমানবশূন্য এলাকাটিতে কোন মানুষজনকেও দেখতে পাচ্ছিলেন না।
পরদিন বেলা ১২টার দিকে ওই এলাকার দুই কিশোর ঢলের পানির সঙ্গে ভেসে আসা লাকড়ি (গাছপালা) কুড়াতে ওই বাঁশঝাড়ের কাছে গেলে প্রভাতী যেন কিছুটা সম্বিত ফিরে পান। কিশোরদের ডেকে তাকে উদ্ধারের আকুতি জানান। কিন্তু নির্জনস্থানে হঠাৎ কোন নারীর করুণ আর্তি শুনে ভয় পেয়ে বাড়িতে চলে যায় কিশোররা। এরপর এক কিশোর তার বাবা নজরুল ইসলামকে ঘটনাটি খুলে বলে। পরে নজরুল নৌকায় এসে প্রভাতীতে উদ্ধার করেন।
জনকণ্ঠকে প্রভাতী হাজং বলেন, রাত দেড়টা থেকে পরদিন বেলা প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বাঁশে ঝুলে থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ভিজা শরীর ক্লান্ত হয়ে একসময় হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর বোধ হয় পারছি না। ওদিকে আমার স্বামী, ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতনির জন্যও চিন্তা হচ্ছিল। বাঁশে ঝুলে ঝুলে ভাবছিলাম পুরো পরিবারটিই বুঝি শেষ হয়ে গেল।
ষাটোর্ধ বৃদ্ধ প্রভাতী বলেন, ‘ওই রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা জীবনেও ভুলব না। এমন প্রবল পাহাড়ী ঢলও ৬৮ বছরের জীবনে দেখিনি। ঈশ^রের অশেষ কৃপা থাকায় বেঁচে গেছি। বাঁচার কোন আশাই ছিল না আমার।’
নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলার ওই অঞ্চলটি মেঘালয় পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত। ওই এলাকাটি দিয়ে বয়ে গেছে ঝরনা আকৃতির বেশকিছু পাহাড়ী ছড়া (নালা)। এসব ছড়া দিয়ে গেল বৃহস্পতিবার রাতে বাঁধভাঙ্গ পানির মতো পাহাড়ী ঢল নেমে আসে। ঘুমন্ত লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় অনেকের বাড়িঘর। এতে নিঃস্ব হয়ে যান অনেকে।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ