By: Daily Janakantha
গুজবের বলি সেই রেণুর পরিবারও আজ গর্বিত
প্রথম পাতা
21 Jun 2022
21 Jun 2022
Daily Janakantha
ফজলুর রহমান ॥ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি দেশের সবচেয়ে বড় সেতু ‘পদ্মা সেতু’। নির্মাণ কাজ শুরু করার আগ থেকেই পদ্মা সেতু নিয়ে ছিল নানা ষড়যন্ত্র। বাধাগ্রস্ত করতে ছড়ানো হয়েছিল গুজব। সেতু নির্মাণে লাগবে শিশুর মাথা। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষ। গুজবে কান দিয়ে ২০১৯ সালে সারাদেশে ২১ জন গণপিটুনির শিকার হন। প্রাণ হারান পাঁচজন। এর মধ্যে ওই বছরের ২০ জুলাই বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেনুর (৪০) হত্যাকা- ছিল সবচেয়ে আলোচিত। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর তথ্য নিতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি এখন বিচারিক আদালতে রয়েছে। যে সেতুকে নিয়ে এত ষড়যন্ত্র, গুজব, বাধা, প্রাণহানি; সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় মাত্র। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার দিনটি সন্নিকটে হওয়ায় দেশবাসীর চোখ পদ্মা সেতুর দিকে। সেতু নিয়ে গুজবের বলি রেনুর পরিবারের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। অধীর আগ্রহে রয়েছেন তারাও। সব বাধা পেরিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে, তাতেই গর্বিত রেনুর পরিবার।
২০১৯ সালে রেনুর করুণ মৃত্যুর সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি স্বজনরা। পদ্মা সেতুকে নিয়ে এই মৃত্যু এখনও পীড়া দেয় তাদের। যখনই পদ্মা সেতুর কথা মনে পড়ে, সেতু নিয়ে কোন কথা কানে আসে, তখনই নাজমুন নাহার নাজমার মানসপটে ভেসে ওঠে বোন রেনুর চেহারা, সেই বর্বরতার চিত্র। যেই চিত্র তিনি দেখেছেন ২০১৯ সালের ২০ জুলাই, বোনকে পিটিয়ে হত্যা করার খবরে ঘটনাস্থলে এসে।
মঙ্গলবার দুপুরে রেনুর বড় বোন নাজমুন নাহার নাজমার মহাখালীর বাসায় গিয়ে কথা হয়। নাজমা বলেন, সেদিন আমি সাভারে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সকালের দিকে রেনুর এ ঘটনা শুনে মুহূর্তের মধ্যে ছুটে আসি। এসে দেখি, রেনুর সমস্ত শরীরে রক্ত। পরনের কাপড় ঠিক নেই। এলোমেলো চুল। অপ্রকৃতস্থ চেহারা। বড়ই করুণ দেখাচ্ছিল তার মুখখানি। এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখা কী যায়? প্রশ্ন ছুড়ে দেন নাজমা।
ওরে (রেনুকে) কতটা নির্মম, নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়েছে, তা চেহারা দেখেই বুঝেছি। সেই বর্বরতার চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যখন পদ্মা সেতুর কথা মনে পড়ে। মিডিয়ায় সেতু নিয়ে সংবাদ দেখলেই বোনের কথা মনে পড়ে। সব সময় বিষয়টা নাড়া দেয়। সেই পদ্মা সেতু আজ চালু হওয়ার পথে। শুনে ভালই লাগছে। আমার বোনের প্রাণের বিনিময়ে এই সেতু। তবে আমার বোন হত্যায় জড়িতদের যদি সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি হয়, তাহলে সেই শোক হয়ত অনেকটা কেটে যাবে। কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নাজমা। নিজের সন্তান, সংসারের পরও রেনুর দুই সন্তানকে দেখাশোনা করা, পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করা, তার পক্ষে অনেকটা কষ্টসাধ্য। তবুও সন্তানের মতো তাদের আগলে রাখেন তিনি।
সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের করুণ মৃত্যুতে আজও কাঁদছেন বৃদ্ধা ছবুরা খাতুন (৭৫)। পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে জেনে তিনিও আনন্দিত। তবে মেয়ের বিচার দেখে যেতে পারবেন কিনাÑ এ হতাশা কাজ করছে তার মনে। জীবদ্দশায় মেয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চান তিনি।
মা মারা যাওয়ার পর খালা নাজমার সঙ্গেই থাকছে রেনুর ৬ বছর বয়সী মেয়ে তাসমিম মাহিরা তুবা। নিষ্পাপ, তুলতুলে আদরে তুবা অনেকটা চঞ্চল প্রকৃতির। বাসার সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল প্রায় সাড়ে ৩ বছর। সেই তুবা এখন অনেকটা বুঝতে শিখেছে। ঘটনার পর পরই তুবা জানত, তার মা আমেরিকা আছেন। আমেরিকা কিংবা দেশের বাইরে থাকলে তো ফোনে কথা বলত। কিন্তু মা তো কখনও কল করে না, কথাও বলে না। তাই তুবা এখন এটা বুঝেছে যে, তার মা অদৃশ্য। তাকে আর দেখা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। তাই তো কখনও টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপনের সময় পর্দায় মায়ের ছবি ভেসে উঠলে তুবা বলে ওঠে, ওই যে মা…। তার দৃষ্টিতে তার মা চাঁদ হয়ে গেছেন। মাকে চাঁদের ভেতর খুঁজে বেড়ায় সে।
তুবার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তুমি বড় হয়ে কি হবা। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব, উত্তরে এমনটি জানায় তুবা। পদ্মা সেতু ঘুরতে যাবা? হু বলে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয় তুবা। উত্তর দিতে সময় নেয়নি, কথায় নেই কোন জড়তা। টসটস করে কথা বলে তুবা। এটা-সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে বড্ড ভালবাসে সে।
রেনুর বড় ছেলে তাহসিন আল মাহির (১৩)। সে মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজে ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। থাকে স্কুলের হলে। মাহির সবই বুঝে। প্রায়ই কম্পিউটার চালু করে মায়ের ছবি দেখে। আনমনে চুপ করে থাকে। সবাই বিষয়টি বুঝতে পারলেও যেন তাদের কিছুই করার নেই। তবে সব সময় মাহির ও তুবাকে হাসি-খুশি রাখতে চান পরিবারের সকলে। মাহির প্রায়ই তার খালাত ভাই (রেনুর বোনের ছেলে ও মামলার বাদী) সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটুকে বলে, ভাইয়া চলো, আমরা একদিন পদ্মা সেতু ঘুরতে যাব। তবে সপরিবারে পদ্মা সেতু ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানালেন টিটু।
সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, আমার খালা পদ্মা সেতু গুজবের বলি। যেই পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব রটিয়ে আমার খালাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। সব বাধা পেরিয়ে সেই পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের জন্য অহঙ্কারের। তার আক্ষেপ, যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে তার খালাকে হত্যার বিচার কাজ শেষ হতো। কিন্তু এখন সপরিবারের পদ্মা সেতুতে ঘুরতে গেলে নিহত রেনুর কথা মনে পড়বে। তখন হয়ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে, এমনটাই বলছিলেন টিটু ও অন্য স্বজনরা। তবুও তারা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেখানে ঘুরতে যাবেন। দ্রুত মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক, এটাই চাওয়া তাদের।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও আদালত সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, রেনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল হক ১৫ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এর মধ্যে দ’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার শুরু হয়। আর পৃথক আদালতে চলছে এ মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১৩ অভিযুক্তের বিচার। তবে করোনা মহামারীসহ মামলার জটের কারণে কিছুটা সময় লাগছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ