By: Daily Janakantha
নিখুঁত ডিজাইন- দেখলে মনে হয় সোনার তৈরি !
শেষের পাতা
19 Jun 2022
19 Jun 2022
Daily Janakantha
সমুদ্র হক ॥ সীতাহার, সাতনরি হারও মিলছে সেই গ্রামে। নেকলেস (মালা বা মনিহার), ব্রেসলেট, চুড়ি, রিং, দুল, ঝুমকা, টিকলি, চূড়, নূপুর, নোলক, বাজু, বিছা কি নেই। ঘরে ঘরে কুটির শিল্পে পরিণত হওয়া এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে গয়নার (গহনা) গ্রামে। এসব গহনা দেখে প্রথমে সোনার গহনা মনে করে হোঁচট খেতে হয়। দাম শুনে সেই ভ্রম কিছুটা ভেঙ্গে যায়। তখন বিস্ময়ে বলতে হয় এত নিখুঁত ইমিটেশন গ্রামের মানুষ কি করে বানাচ্ছেন! পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এই গহনা বানাচ্ছেন।
বগুড়া নগরী থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৫ কিলোমিটার দূরে বারোপুর, দক্ষিণপাড়া, ধরমপুর গ্রামে তৈরি হচ্ছে এসব গহনা। এর কাঁচামাল তামা ও পিতল। যা পাইকারি দরে কিনে আনা হয় দক্ষিণাঞ্চলের যশোর থেকে। এই তামা ও পিতল গলিয়ে গহনার নক্সার ডাইসে ভরে দেয়া হয়। এই ডাইস আগে আসত যশোর থেকে। বগুড়ার অনেক কারিগর নিজেদের মেধায় ডাইসের নক্সা বানিয়েছে।
সে রকম কোন যন্ত্রপাতি নেই। মণিকাররা (স্বর্ণকার) হাতের কাজে (ম্যানুয়ালি) যে ছোট হাতুিড় ও আনুষঙ্গিক জিনিস ব্যবহার করে এদের কাছেও তাই থাকে। কাটিং করার জন্য ছোট একটি যন্ত্র কিনে নিয়ে তার মধ্যে মাল্টিপল ফাংশন জুড়ে দেয়া হয়েছে। ছোট ও মাঝারি গহনা রং ও পলিশ সেই যন্ত্রেই হয়। গহনার মধ্যে সকল ধরনের পাথর বসিয়ে দেয়া হয়। ক্রেতারা সীতাহার, সাতনরি হারের মতো বড় গহনাগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আরও ভাল ফিনিশিং দেয়। তামা ও পিতলের তৈরি এসব গহনা বগুড়া থেকেই বিপণন হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়। কোন কোন ইমিটেশনের দোকানি এসব গহনাকে ভারত সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বলে বিক্রি করেন।
কোন গহনা মুঘলদের নক্সার মতো। চুড়ি, বালা, ব্রেসলেট, রতনচূড় (পাঁচ আঙুলে আংটি চেইনে রেখে ব্রেসলেটের সঙ্গে এঁটে দেয়া), বাহুতে বাজু, আঙ্গুলে আংটি, গলায় মনিহার ও গোলাকৃতির হয়ে এঁটে থাকা চিক। কানে ঝুমকো। কোনটি জড়োয়ার। নাকে নোলক, সিঁথির টিকলি, পায়ের নূপুর ও মল। কোমরের বিছা। গলা থেকে ডিম্বাকৃতির লম্বা সীতাহার। সাতনরি হারও নেকলেসেরই কত বাহার। সবই মুঘল আমলের নক্সার আদলে গড়া। বোঝার কোন উপায় নেই।
গহনা তৈরির ছোট প্রতিষ্ঠানের নামও আছে। বাড়ির মালিক অথবা তার স্ত্রী সন্তানের নামের সঙ্গে ‘গোল্ড হাউস ও কারখানা’ জুড়ে দিয়ে একটি পরিচিতি দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা গ্রামে গিয়ে পাইকারি দরে গহনা কিনে নিয়ে যায়। কেউ ক্যাটালগ দেখিয়ে পছন্দের গহনা বানিয়ে নেয়। কারিগর রেশমা জানালেন, বর্তমানের অনেক তরুণী ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল ও মুম্বাই ফিল্মের তারকাদের পরিহিত গহনা গুগল থেকে নামিয়ে স্মার্ট ফোনে তুলে এনে দেখায়। কারিগররা শেয়ারআইটি প্রোগ্রামে তা তুলে নেয়। পরে অবিকল বানিয়ে দেয়া হয়। কোমরের বিছা নোলক নূপুর বিক্রি বেড়ে গিয়েছে।
বারোপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের কয়েকজন জানালেন নিকট অতীতে এই গ্রামের মানুষের সচ্ছল অবস্থা ছিল না। কেউ কৃষি কাজ করেছে। অনেককেই কর্মহীন হয়ে থাকতে হয়েছে। বছর কয়েক হয় এই গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি পাড়া ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে করোনার কারণে গত দু’বছর ব্যবসা তেমন হয়নি। চলতি বছর ঈদের সময়ে যে ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। কাঁচামালের দাম বেড়েছে। অনেকে কাঁচামাল (তামা ও পিতল) কিনে আনে বাইরে থেকে। কারিগররা অন্য ব্যবসার নেমেছে। তারা ফিরে এলে ফের বেচাকেনা বাড়বে।
একজন জানালেন, প্রতিটি ডাইসে বহু ধরনের নক্সা থাকে। ডাইস থেকে গহনা বের করে তার ওপর নিজেরাও কিছু কাজ করে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছোট ছোট পাথর বসিয়ে নক্সাকে ধরে রাখা। সাতনরি হার ও সীতাহার বানাতে অন্তত তিন দিন সময় লাগে। অভিজ্ঞ কারিগররা এই হার বানায়। গ্রামের সফর আলী মানিক এক সময় মণিকার (সোনার কারিগর) ছিলেন। স্বর্ণের কাজের অভিজ্ঞতা তিনি লাগিয়েছেন ইমিটেশনের কাজে। মানিক বললেন, সোনার কাজ ও ইমিটেশনের কাজ প্রায় একই। এসব ইমিটেশনে ইলেকট্রোপ্লেটিং করা হয়।
বেশিরভাগ কারিগর গহনার কাজ শিখেছেন আটাপাড়া গ্রামে। বগুড়ার এই গ্রামটি স্বর্ণকারের গ্রাম নামে অধিক পরিচিত। মূলত এই গ্রামের লোকজনই তামা পিতলের গহনা তৈরি করে প্রথমে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ