বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা, নির্যাতন ও গুলি চালানোর ঘটনার কথা সবার জানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখতে পারেনি শিক্ষার্থীদের। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থী ও মানুষের রোষানলে পড়ে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।এদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে জয় পেলেও এর আগ পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এ কথা যেমন সত্য, একইভাবে সংগীত ও শোবিজ তারকা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সরকারের পক্ষে কথা বলার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ অনেকের। এবার এ বিষয়ে কথা বললেন তরুণ সংগীতশিল্পী তাসরিফ খান।‘কুঁড়েঘর’ গানের দলের তরুণ এই গায়ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ শীর্ষক একটি গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সবমিলে আন্দোলনের পক্ষে কথা ছিলেন তাসরিফ খান। এ কারণে গত জুলাইয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে রড দিয়ে বেধড়ক মারধরও করা হয়েছিল। তারই বর্ণনা দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের এ গায়ক।বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টায় ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজে এক স্ট্যাটাসে তাসরিফ খান ‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছেন, ‘২৩ জুলাই রাত ১টার কথা বলছি। একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললেন, “তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।” ৫ জুলাই থেকে ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট করা, কবিতা লিখতে থাকা এবং “রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম” গানটা ফেসবুকে চলতে থাকায় সরকারি গুন্ডা বাহিনীর থ্রেটে আমি তখন বাসার বাইরে অবস্থান করছিলাম। ওই সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে, আমি তখন বাসার সামনে আসি উনার সঙ্গে দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জনের মতো নেমে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আমাকে একটু সাইডে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলে, “সঙ্গে যারা আছে তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার বাহিনীর কয়েকজনও আছে এখানে।” আমি তখন উনার কাছে জানতে চাই যে উনারা কেন এসেছেন এবং কি চাচ্ছেন মূলত।’‘উনি তখন বুঝায় বলে, “সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরও ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকব। আমরা ঠিকমত বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হইব, এর বাইরে কোনো রাস্তা নাই।” এই কথা বলে উনি আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলে, “তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিতেছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা।” সেই ইন্সুরেন্সার তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাকে বলে, “দেখ তাসরিফ, পিএম’র চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ, ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যতদিন আছে সুবিধা পাবি।” কথা শেষ করার আগেই উনি পকেট থেকে এক লাখ টাকার তিনটি বান্ডেল, মোট তিন লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এইটা সামান্য ছোট একটা গিফট। টাকা যত চাস, তত দেয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর।”’তাসরিফ খান লিখেছেন, ‘ঠিক এই সময় আমার ফোনে আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নম্বর থেকে একটা ফোন আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তাসরিফ, পাঁচ-ছয় জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে।” শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা একরকম কাঁপতে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়াটা কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য, ভয় দেখানো? নাকি কেবলমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? শান্তর লাইন কেটে যায়। আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেয়া তাদেরকে বলি, “ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে।” ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আরেহ, দেশের যে অবস্থা, এটা এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে।”’‘আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি ওদেরকে টাকা ফেরাই দেই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা আমাকে চাইলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারে। আমি তাই মাথা ঠান্ডা করে ওদেরকে বলি ঠিক আছে, আমি দেখতেছি কি করতে পারি, কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। ওরা আমাকে তখনও একরকম থ্রেট দিয়ে বলে, “ভাই জানাচ্ছির সুযোগ নাই। সিচুয়েশন তো বুঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে।” সঙ্গে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলে, “তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে, সো বুইঝা শুইনা সুন্দর কইরা করিস।” ওদের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি বাসায় ফেরত যাই। বাসায় সবাইকে সব সিচুয়েশন জানিয়ে আমি আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিতকে ফোন দিয়ে বলি, “আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নম্বর দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে ওদেরকে দিয়ে দিবি কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কারণ আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।” ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা, ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মুর অবস্থা, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সঙ্গে বেঈমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে, সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সঙ্গে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই কান্না ভরা আর্তনাদ।’তিনি আরও লিখেছেন, ‘কষ্টের ব্যাপার কি জানেন? এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন দিয়ে বলছিল, “খান, আমার বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুরবেলা খাওয়া হয় নাই, একটা দোকানও খোলা নাই; আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে, কি করব?”  আমি শান্তকে বলছিলাম, “এক বড় ভাই ফোন দিছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে, তো তুমি আমার বাসায় চইলা আসো, দুই ভাই একসঙ্গে খাব।” ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে, অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়কভাবে মাইর খাইতে হইল। মার খাওয়ার পরে ফোনে সে আমাকে এটাও বলছিল যে, “খান, সবাই আমারে একসঙ্গে রোল দিয়ে মারতেছিল আর একজন বন্দুক তাক করে চিল্লায়ে বলছিল, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা, নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইব না তোর পরিবার।” শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদতেছিল যে, “আমাকে ছাত্র বইলা বইলা ওরা মারছে আর বারবার বলতেছিল যে, এই অমুকের পোলা ছাত্র। ওরে মার।”’সবশেষ তাসরিফ খান লিখেছেন, ‘ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই। আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর “রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম”-এর মতো কিছু গান করা ছাড়া দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নাই। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে যেয়ে বুক পেতে দিতে পারি নাই। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয় নাই। তবে, আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হয় নাই, আর দেশের সঙ্গে বেঈমানি করি নাই। আর এই পোস্ট, পোস্টে শান্তর ছবিগুলা এবং ওদের নির্মমতার কথাগুলা আমি লিখে পোস্ট করছি এই কারণে, যেন ভবিষ্যতে কখনো এই স্বৈরাচারের প্রতি আমার ঘৃণা এতটুকু পরিমাণও কমে না যায়।এফএস

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
জলবায়ু খাতে বিশেষ বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা 
জলবায়ু খাতে বিশেষ বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা 

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে।

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস
আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে ঢাকাসহ সারাদেশে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর Read more

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত হয়নি: উপদেষ্টা রঞ্জন রায়
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত হয়নি: উপদেষ্টা রঞ্জন রায়

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় ভৌত কাঠমোর উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও আমরা Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন