By: Daily Janakantha
বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে…
শেষের পাতা
16 Jun 2022
16 Jun 2022
Daily Janakantha
মোরসালিন মিজান ॥ বেশ ভালভাবেই ফিরলো বর্ষা উৎসব। আষাঢ়ের প্রথম দিনে বুধবার রাজধানীতে একাধিক উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গান নাচ কবিতার ভাষায় প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেন শিল্পীরা। গত দুই বছর করোনার কারণে অনেক কিছুই থমকে গিয়েছিল। একই কারণে বর্ষা উৎসব থেকে অনেকটাই সরে আসতে হয়েছিল নগরবাসীকে। অবশেষে সেই বন্ধ্যত্ব দূর হয়েছে। শতভাগ আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিরেছে বর্ষা উৎসব।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা কাল। এ সময় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। টানা বৃষ্টিতে দূর হয়ে যায় গ্রীষ্মের খরা। কৃষির জন্য বিশেষ উপযোগী বৃষ্টি বাঙালীর প্রতিদিনের জীবনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। বর্ষার বৃষ্টি আবেগে ভাসায়। অজ¯্র কবিতা গানের জন্ম দেয়। আরও কত কী! স্বতন্ত্র ঋতুকে তাই নানা আয়োজনে বরণ করে নেয়া হয়। চলে উৎসব অনুষ্ঠান। এবারও তাই হলো। সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। শিল্পীরা সংস্কৃতিকর্মীরা এসেছিলেন। পোশাকে মেঘের রং। সাধারণ মানুষও নীল বা আকাশী রঙের শাড়ি পাঞ্জাবি পরে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।
এদিনের মূল আয়োজন ছিল বাংলা একাডেমি চত্বর ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। দুটি ভেন্যু থেকে প্রায় একই সময়ে শুরু হয় বর্ষা বন্দনা। একাডেমির প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে বর্ষা উৎসব আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। টিএসসিতে অনুষ্ঠান সাজিয়েছিল বর্ষা উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। উভয় আয়োজনের চরিত্রও প্রায় এক ছিল। মঞ্চে নাচ গান হয়েছে। ছিল কবিতাও। এসব পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ষাকে নাগরিক সমাজের সামনে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়। টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে ঋতু বন্দনা। বাঙালীর নিজস্ব শিল্প সাহিত্য লোকায়ত সংস্কৃতিরও প্রকাশ ঘটে বর্ষা উৎসবে। এ কারণে উৎসবগুলো আন্দোলন সংগ্রামেরও অংশ। শুরুটা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন। কবিগুরুর হাত ধরেই আজকের বর্ষা উৎসব। বর্ষামঙ্গল উপলক্ষে বহু গান রচনা করেছিলেন তিনি। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে সেসব গানের বিশাল ভা-ার থেকে শিল্পীরা বর্ষাকে আবিষ্কার করেছেন। দ্রোহের কবি নজরুলও বর্ষা নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। দারুণ সব গান লিখে গেছেন। কবির গানও গাওয়া হয়েছে উৎসবে। এর বাইরে ছিল ভাটিবাংলার লোকসাধকদের গান। নাগরিক পরিবেশেও গানগুলো সমান আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছিল। নৃত্যশিল্পীরা অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় গানের সঙ্গে নেচেছেন। একইভাবে প্রিয় কবিতার পঙ্ক্তি থেকে বর্ষাকে খুঁজে নিয়েছেন বাচিক শিল্পীরা।
এদিন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে সকাল ৭টার দিকে শুরু হয় উদীচীর বর্ষা উৎসব। এখান থেকে সেতার বাদনের মধ্য দিয়ে বর্ষাকে প্রথম আবাহন করা হয়। মেঘমল্লার রাগ বাজিয়ে প্রিয় ঋতুকে স্বাগত জানান জ্যোতি ব্যানার্জি। পরে সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, মেহেদী ফরিদ ও রেজাউল করিম টুলু। শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও ছিল রবীন্দ্রনাথের গান, যেখানে বলা হয়, ‘বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,/কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে।’ কখনোবা তারা লালনের হাহাকার তুলে ধরে গেয়েছেন, ‘চাতক মলে যাবে জানা/ঐ নামের গৌরব রবেনা/ জল দিয়ে কর সান্ত¦না/অবোধ লালনে/চাতক বাঁচে কেমনে/ মেঘের বরিষণ বিনে।’ উৎসবে নাচের মুদ্রায় বর্ষাকে তুলে ধরেন কাফরুলের শিল্পীরা।
পৌনে ৮টার দিকে এ মঞ্চে যখন গাওয়া হচ্ছিল ‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে’ তখন টিএসসির মঞ্চে এসে শোনা গেল ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী।’ জনপ্রিয় এ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করছিলেন একদল শিল্পী। পরের গানে লোকজ সুর। বহ্নিশিখার শিল্পীরা বর্ষায় প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বেদনা তুলে ধরে শোনান ‘বন্ধু আমার রইলো বৈদেশ গিয়া’ গানটি। তার আগে আষাঢ় মাসে মন কেমন আকুলি বিকুলি করে তা গানে গানে তুলে ধরার চেষ্টা করে দলটি।
বর্ষা উৎসবের ভীষণ প্রিয় কণ্ঠ বিমান চন্দ্র বিশ^াস। তার কণ্ঠে ছিল উকিল মুন্সির বিখ্যাত গান। সুরেলা ধারালো কণ্ঠে তিনি গাইছিলেন, ‘যে দিন হতে নয়া পানি আইল বাড়ির ঘাটে সখি রে/ অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে।’ এর পরই রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘হে গম্ভীর।’ গেয়ে শোনান এ ধারার গানের উল্লেখযোগ্য শিল্পী অনিমা রায়। তানভীর আলম সজীবের কণ্ঠে ছিল রাগ নির্ভর গান, শিল্পী গাইছিলেন ‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে।’ নবীনতম শিল্পীদের মধ্যে নবনীতা জাইদ চৌধুরীর কণ্ঠে বর্ষা বন্দনা মুগ্ধ করে শ্রোতাদের।
উৎসবে গান করেন খ্যাতিমান শিল্পী মহাদেব ঘোষও। তার কণ্ঠে ছিল ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে…।’ মনকে সত্যি জাগিয়ে দিয়ে যান সিনিয়র এ শিল্পী। তার আগে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র। সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা গায় : কলকল ছলছল নদী করে টলমল/ঢেউ ভাঙে ঝড়-তুফানেতে/নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে/তুমি নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে…। দলীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আরও ছিল সত্যেন সেনশিল্পীগোষ্ঠী, পঞ্চভাস্কর, সুর বিহার ও সুর সাগর ললিতকলা একাডেমি।
গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে নাচ। নাচের মাধ্যমে উৎসবের রংটা প্রকৃত অর্থেই ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। এদিন দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন স্পন্দন, নৃত্যাক্ষ, সুর বিহার, নিক্কণ পারফরমিং আর্ট সেন্টার ও নৃত্যজন। কবিতার ভাষায় বর্ষা বন্দনা করেন মাসকুর-এ-সাত্তারকল্লোল ও নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলি।
এসবের বাইরে ছিল বর্ষা কথন। অবশ্য আয়োজকরা ‘বর্ষাকথন’ বললেও, আসলে গতানুগতিক আলোচনাই হয়েছে। শিল্প সাহিত্য অঙ্গনের বিশিষ্টজন ড. হায়াৎ মামুদ মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও, কথা বলেননি। মূলত আলোচনা করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান। উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি ড. নিগার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী মানজার চৌধুরী সুইট এ আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন।
এদিকে বাংলা একাডেমিতে উদীচী প্রতি বছর অনুষ্ঠান করলেও সেখানে মূলত সংগঠনের শিল্পী ও কর্মীরাই উপস্থিত থাকেন। এবারও তেমনটিই দেখা গেছে। তবে টিএসসির মূল ভবনের সামনে খোলা জায়গায় আয়োজিত বর্ষা উৎসবে সাধারণের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সীমানা প্রাচীরের ওপর বসে শূন্যে পা দুলিয়ে এমনকি পথশিশুরা মজা করে গান শুনেছে। নাচ উপভোগ করেছে তারা। তবে একই উৎসব বহু বছর ধরে চারুকলার বকুল তলায় হয়ে আসছে। সেখানে উৎসবটি আরও বেশি মানানসই। এবার কী এক ছুঁতোয় ভেন্যুটি আয়োজকদের দেয়া হয়নি। ভবিষ্যতে এ বাধা ঘুচবে, এমন আশা আমরা নিশ্চয়ই করব।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ