By: Daily Janakantha
এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়…
প্রথম পাতা
14 Jun 2022
14 Jun 2022
Daily Janakantha
মোরসালিন মিজান ॥ এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়…। হ্যাঁ, বাঙালীর ঘনঘোর বরিষা এসেছে। আজ ১ আষাঢ়, বাঙালীর ভীষণ প্রিয় বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। করোনা হেতু গত দুই বছর বর্ষাবরণ উৎসব অনেকটাই থমকে গিয়েছিল। এবার ব্যাপক আয়োজনে ফিরছে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বাংলা একাডেমি টিএসসি শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থানে হবে জমজমাট নাগরিক উৎসব।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ- এ দুই মাস বর্ষাকাল। প্রিয় ঋতু ঘিরে বাঙালীর আবেগ উচ্ছ্বাস চিরকালের। বর্ষাকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলেÑ/ মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।’ নজরুলের ভাষায় : ‘রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/ কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে।’ হাওড়ে বর্ষার যে রূপ দেখা যায় তা অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাত জেলার লোকসাধকরা বর্ষা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁদের অন্যতম উকিল মুন্সিও সরব হয়েছিলেন এ সময়। গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান: ‘যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে…।’
অবশ্য আজ বর্ষার আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও কদিন ধরে কম বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টি বর্ষার আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছে। আর মূল যে শুরু, সেটি আজ হলো। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্ষায় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। গ্রীষ্মের ধুলোয় মলিন প্রকৃতি পরিবেশ এ সময় তার শরীর ধুয়ে নিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়। সতেজ হয়ে ওঠে গাছ পালা। সুগন্ধী সব ফুল ফোটতে থাকে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ হাসিমুখে স্বাগত জানায় বর্ষাকে। দোলনচাঁপা গন্ধরাজ বেলী বকুল জুঁই হাসনাহেনার ঘ্রাণও মাতাল করে রাখে।
বর্ষায় প্রকৃতির মতো মানুষের মনেও এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কেউ বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করতে জানালার কাছে ছুটে যান। কেউবা গিয়ে দাঁড়ান বারান্দায়। আনমনা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর বৃষ্টিতে ভেজা, ¯œান, সে তো বিপুল আনন্দের হয়ে ধরা দেয়। বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুল কলেজ থেকে ফেরার সময় ইচ্ছে করে ভিজতে দেখা যায় দুরন্ত কিশোর-কিশোরীদের। বিশেষ করে মেয়েরা বৃষ্টি পেলে যেন ময়ূরের মতো পাখা মেলে দিতে চায়। ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।’ সেই নাচ এরই মাঝে ফিরেছে কিন্তু! গ্রামে স্কুলের মাঠে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই চলছে ফুটবল খেলা।
বর্ষা মনকে ভীষণ শিহরিত করে। প্রেমের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধকে উস্কে দেয় অবিরাম বর্ষণ। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়, ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা। একই অনুভূতি থেকে দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল লিখেছেন, ‘রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা।’ ঠিক পরের পঙ্ক্তিতে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতা থেকে কবি লিখেন: ‘চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা।’ সমকালীন কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও মজার কথা বলেছেন। তার মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব।
প্রেমের কথা হলো যদি বিরহ আর বাদ থাকে কী করে? বর্ষায় একইসঙ্গে বিরহ জাগানীয়া ঋতু। পুরনো বিয়োগ ব্যথা, পেয়ে হারানোর শোক নতুন করে বুকে বেজে ওঠে এ সময়। রিক্ত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি একেবারে আত্মসমর্পণ করেই বলছেন, ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।’ একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমন দিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ গেয়েছিলন: ‘প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া।’ অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল।’ কষ্টটা আরও স্পষ্ট হয় নজরুলের গানে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’
তবে বর্ষার আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে হাওড়কে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা এবং পাহাড় গড়িয়ে নেমে আসা জল হাওড়কে একরকম জন্ম দেয়। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করেন কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। পথ ঘাট জলে এমনভাবে তলিয়ে যায় যে, মনে হয় আর কোনদিন জাগবে না। এ সময় নৌকাই যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে সামনে আসে। এক বাড়ি থেকে আরকে বাড়ি বা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকো ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। বিয়ের মতো আয়োজনেও নৌকার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বর্ষাকে সেখানে বিয়ের মৌসুম হিসেবে বেছে নেয়া হয়। নৌকা সাজিয়ে নিয়ে বরযাত্রীরা কনে বাড়িতে যান। একই নৌকা করে বাড়ি নিয়ে আসেন নতুন বউ। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সে দৃশ্য দেখে উকিল মুন্সি দৃশ্যের আরও গভীরে গান: ‘গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে।’
তবে, হ্যাঁ, বর্ষার সবই সমান উপভোগ্য নয়। এমনটি ভাবলে চলবে না। কারণ ভারি বর্ষণে, বন্যায়, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা। বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষজন তাই এ সময়টা আতঙ্কে পার করেন। অতি বৃষ্টিতে সারাবছরের শ্রমে ঘামে ফলানো ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিমের ভাষায়: ‘আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়।’ একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না আর। এসবের বাইরে কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো প্রতিদিনের। বর্ষার কাছে তাই প্রার্থনা : ‘এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা…।’
বর্ষা উৎসব ॥ আজ নানা আয়োজনে রাজধানীতে বরণ করে নেয়া হবে বর্ষা ঋতুকে। বাংলা একাডেমিতে উৎসবের আয়োজন করেছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সকাল ৭টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। আয়োজকরা জানাচ্ছেন, নজরুল মঞ্চে গান নাচ কবিতার ভাষায় বরণ করে নেয়া হবে বর্ষাকে। একই সংগঠনের অভিন্ন আয়োজন থাকবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরে। এখানে বেলা ১১টায় শুরু হবে উৎসব।
সকাল সাড়ে ৭টায় একইরকম আয়োজন টিএসসির ভেতরে সবুজ চত্বরে। এবার প্রথমবারের মতো এখানে উৎসব আয়োজন করেছে বর্ষা উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। চারুকলার আয়োজনটি এখানে স্থানান্তর করতে হয়েছে। সে অনুযায়ী, সবুজ চত্বরের মাঝখানে মঞ্চ গড়া হয়েছে। মঞ্চ থেকে জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন। থাকবে দলীয় নৃত্য। একক পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে থাকবেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। কবিতা এবং কথনেও বর্ষার নানাদিক তুলে ধরা হবে। অভিন্ন আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমিতেও বর্ষাকে আবাহন করা হবে। সব মিলিয়ে ব্যাপক আয়োজন। সবাইকে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আয়োজকরা।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ