By: Daily Janakantha
টরেন্টোর চিঠি ॥ মাটির ব্যাংকটা সামলে রাখুন!
চতুরঙ্গ
14 Jun 2022
14 Jun 2022
Daily Janakantha
ইদানীং যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে সেটি হচ্ছে- বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করায় জনস্বাস্থ্যের নানা অলি-গলি পেরুলেও এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা একবারে ছাড়তে পারি না। সবসময়ই হয় অর্থনীতি আমাকে অথবা আমি অর্থনীতিতে কেন্দ্র করে চলতে থাকি। করোনা মহামারীর সময় বিশ্বের প্রায় সব দেশই তাদের নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় সামাজিক সুরক্ষামূলক অনেক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, মানুষকে কোটি কোটি টাকা নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে, খাদ্যসহ অন্যান্য সাহায্যও দেয়া হয়েছে। এই সময় নানাক্ষেত্রে দেখা গেছে উন্নত বিশ্বের মানুষের আয় এমনকি আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। ফলে, সেই টাকা ব্যয় হয়েছে ভোগ্যপণ্য ও বস্তুতে। করোনা মহামারী মোটামুটি শেষ হয়ে যাবার পরে সব সরকারই নড়েচড়ে বসেছে। সামাজিক প্রতিরক্ষা ব্যূহের জন্য তৈরি করা সহায়তা বন্ধ করেছে এবং গত তিন বছরে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির মাশুল গুনতে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে ভয়াবহভাবে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন মুদ্রাস্ফীতির এই ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির সর্বকালের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে বহুগুণে, ঘরবাড়ির হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দামে লাগাম এসেছে, মানুষের আয় না কমলেও ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে মুদ্রামান কমে গিয়ে জীবনমানে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের মন্দার প্রভাব স্বভাবতই ধাক্কা দেয় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। ব্যাংকে রিজার্ভে টান পড়ে, সরকার উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমিয়ে দেয়, বেকারত্ব বাড়ে, ফলে বাড়ে সন্ত্রাস, অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি।
বাজারের গরম বাংলাদেশের সবাইও ইতোমধ্যে টের পাওয়া শুরু করেছেন। এটি সামনে আরও বাড়বে যা নিয়ে সবাই খুব একটা উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে না আমার। মুদ্রাস্ফীতির এই অস্বাভাবিক বছরে ইউক্রেনে শুরু হয়েছে এমন এক যুদ্ধ যার মূল প্রতিপক্ষ রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তাদের সামরিক খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়েছে বহুগুণ যা ব্যয় হবে যুদ্ধাস্ত্র কিনতে এবং এর একটা বড় অংশ যাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ ও দ্বিতীয় শক্তিশালী সামরিক শক্তির রাশিয়াও আলাদাভাবে সখ্য গড়ে তুলছে চীন, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে। তাদের তেল, খনিজসম্পদ ও কৃষিপণ্য এখন বিশ্বের অনেক দেশকে কিনতে হচ্ছে রাশার নিজস্ব মুদ্রা ‘রুবলে’, ফলে রুবলের বাজার এখন চড়া। যে দুটো দেশ এই যুদ্ধ বাধাল, খেয়াল করে দেখুন, তাদের, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অর্থনীতিই চাঙ্গা হচ্ছে। অন্যদিকে বাকি বিশ্ব চড়া দাম দিচ্ছে এই যুদ্ধের। নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে গিয়ে তারা সামাজিক খাতে ব্যয় কমাচ্ছে যার প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনমানে। অন্যদিকে ইউক্রেন আজ ধুলোয় মিশে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতে ন্যাটো যোগদানের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করতে গিয়ে আজকে তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, যার খুব কমই আমি আপনি দেখতে পারছি পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলগুলোতে। যারা কিছু বাস্তব তথ্য জানতে চান তারা ফ্রান্সের চ্যানেল ঋৎধহপব২৪ ঊহমষরংয এবং ইউটিউব ভিত্তিক ভারতীয় চ্যানেল ডওঙঘ ঞঠ দেখতে পারেন। এখানে কিছুটা হলেও সত্য জানা যাচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির এই অবস্থা সম্পর্কে পাঠকদের জানানো দায়িত্ব মনে করছি। আমার সীমিত অর্থনীতির জ্ঞানে আমি আশঙ্কা করছি মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং এর উত্তরণে ৩-৫ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এখন অর্থনীতির সূত্র অনেক, হাজার হাজার সূচকের ওপর নির্ভর করে, তাতে যে কোন সময় পাল্টে যেতে পারে। আমি যতটুকু বুঝি এবং গত ৬ মাসে যতটুকু দেখেছি তাতে এ থেকে পরিত্রাণ খুব কঠিন হবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য। সরকার নিশ্চয় তার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নীতি নির্ধারণ করবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের উচিত হবে ব্যয় সঙ্কোচন নীতিতে যাওয়া, নিরাপদ জায়গায় অর্থের বিনিয়োগ করা এবং একটি নির্দিষ্ট খাতে না করে বিনিয়োগ ভিন্ন ভিন্ন খাতে করা। যারা চাকরি করেন, তাদের উচিত হবে একটি বিকল্প আয়ের সংস্থান করা। ছোটখাটো ব্যবসা বা অনলাইনভিত্তিক আয়ের ব্যবস্থা রাখা। আমি নিজে অর্থ ব্যবস্থাপনার কোন বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আপনারা এই বিষয়ে চোখ কান খোলা রেখে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলা শুরু করতে পারেন।
যাই হোক, অর্থনীতি নিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম। পদ্মা সেতু নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ষড়যন্ত্রের বড় অংশটা আভ্যন্তরীণ ছিল। দেশের ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রভাবশালী সিনেটরের প্রতিষ্ঠানকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা দেয়া হয়েছে, যাতে বিশ্বব্যাংকের দেয়া ঋণ বন্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো যায়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বমানের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ কখনও কল্পনা করেছেন বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে আছে বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রত্যাখ্যান করার পরপর নিউ মার্কেটে হাঁটতে গিয়ে ব্যানার দেখেছি, যেখানে সরকারী ব্যাংকে পদ্মা সেতুর জন্য জনগণের কাছে অর্থ সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল। দেশের অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা একদিনের বেতনও সরকারকে দিয়েছিল এর অর্থায়নে। শেষমেশ শতভাগ দেশী অর্থ সঙ্কুলানে এই সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এই সেতুর খরচের বিষয়েও বিরোধী দল অনেক মিথ্যাচার করছে। তারা এমন সব সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর খরচের তুলনা দিচ্ছে যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, নদী শাসনের ব্যাপ্তি কোন কিছুর সঙ্গেই সেতু কিংবা পদ্মা নদীর কোন তুলনা চলে না। যাই হোক, কথার চাইতে কাজ বড়, পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। প্রমত্ত পদ্মার বুকে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের সাফল্যের জানান দিয়ে।
গত সপ্তাহে কানাডার গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ অন্টারিওতে প্রাদেশিক নির্বাচন সম্পন্ন হলো। আমার আগের লেখার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন বর্তমান প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ডের প্রোগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি ৮৩টি আসন নিয়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ সরকার গঠন করল। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টি মাত্র ৮টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে নির্বাচন শেষ করেছে। এমনকি অন্টারিওতে তাদের দলীয় প্রধান নিজের আসনে পরাজিত হয়েছে। লিবারেল পার্টির এই পরাজয় সারা বিশ্বব্যাপী উগ্র ডানপন্থীদের উত্থানের যে আগমনী সুর বেজে চলেছে, কানাডাও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, সেই দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে বোধ করি। অনেকে ধারণা করেন, লিবারেল পার্টি যে পরপর দুই মেয়াদের কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে, তার মূল কারণ জাস্টিন ট্রুডোর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে ট্রুডোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে হয়ত অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড প্রোগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন লিবারেল পার্টির বর্তমান উপ-প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিনা ফ্রিল্যান্ডের সঙ্গে। তবে এই নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের জয়ের মাঝেও আনন্দের খবর হচ্ছে বাংলাদেশী কানাডিয়ান ডলি বেগম দ্বিতীয়বারের মতো বিরোধী দল নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাদেশিক সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এবারই প্রথম আরও দুজন বাংলাদেশী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা কেউই জিততে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশী কানাডিয়ান প্রার্থীরা আরও বেশি রাজনীতি করবেন এবং নির্বাচনে প্রার্থিতা নেয়ার চেষ্টা করবেন, এই প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশী কমিউনিটি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার কোন বিকল্প নেই। ডলি বেগম যেহেতু দ্বিতীয়বারের মতো জিতলেন, তাই হয়ত তিনি এখন অন্য বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের তার রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে অবগত করে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন।
সবাইকে রৌদ্রোজ্জ্বল টরেন্টো থেকে শুভেচ্ছা জানাই। সুন্দর কাটুক আপনার সামনের দিনগুলো।
১৩ জুন ২০২২
টরেন্টো, কানাডা
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ