By: Daily Janakantha
পাঁপড় কন্যাদের গল্প
অপরাজিতা
14 Jun 2022
14 Jun 2022
Daily Janakantha
স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি গঠনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে নারী উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছাড়াও কৃষি, পোশাক কিংবা অন্যান্য শিল্প বিকাশে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের মূলধারার কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী শিল্প, কৃষি ও সেবাসহ অন্যান্য খাতে কাজ করছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এর সঙ্গে সংসারের কাজ এবং বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান সমান সমান। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। স্বল্প বিনিয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ থাকায় বিভিন্ন জেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে।
কালো জিরা, সয়াবিন তেল, গরম মসলা জাতীয় উপাদান ও বিভিন্ন রকম ডাল, বিশেষ করে মুগ ডাল, মাসকলই ডাল ও খেসারির ডাল একত্রিত করে মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়া করে সয়াবিন তেল মিশিয়ে খামির তৈরি করে তা থেকে লম্বা লম্বা তৈরি হয় গুঁটি, আবার সেই গুঁটি বেলন দিয়ে বেলে রোদে শুকিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায় পাঁপড়।
ঐতিহ্যবাহী দিনাজপুর জেলায় প্রাচীনকাল থেকেই পাঁপড় একটি সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্রশিল্প। আমাদের গবেষণায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায়, ঘরে কিংবা একত্রিত হয়ে পাঁপড় তৈরি করে নারীরা। তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে এই শিল্প। শহরের চকবাজার, নতুনপাড়া, গুঞ্জাবাড়ির মাঠ, বাসুনিয়াপট্টি, চুড়িপট্টি, রাজবাড়ী, ফকিরপাড়া, বড় বন্দরের অলিগলিতে প্রায় ঘরেই পাঁপড় তৈরি এবং পাঁপড় তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।
তথ্য দাতাদের মতে বর্তমানে দিনাজপুর শহরে পাঁপড় উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি আনুমানিক ১২ হাজার নারী শ্রমিক জড়িত। পাঁপড় তৈরিতে দিনাজপুরে ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে। পাঁপড় তৈরিতে যুক্ত হয়ে অনেক নারীদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাতকারে জানা যায় ১ জন নারী শ্রমিক প্রতিদিন গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি গড়ে ২০০ টাকা আয় করেন। সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের হাত খরচসহ সংসার পরিচালনা খরচের যোগান এই কর্ম থেকেই হয় অনেক নারীর। গবেষণায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শহরের বটতলী, যগনবাবুর মাঠ থেকে চকবাজার পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিজ বাসায় কিংবা কারখানায় নারীদের পাঁপড় তৈরির দৃশ্য চোখে পড়ে। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় সারি সারি পাঁপড়ের দোকান। এসব দোকানে নারীদের তৈরিকৃত পাঁপড় বিক্রি করতে দেখা যায়।
নারী শ্রমিক গোলাপী রানী (৩৫) তার সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন ‘জেলায় নারী বেকারত্ব ঘোচাতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এই অঞ্চলে নারীদের অর্থনীতিতে এনে দিয়েছে গতি। বহু নারী এই পাঁপড় তৈরির কাজ করে সংসার চালান ও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ জোগায়।’
দিনাজপুরের পাঁপড় সারাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পাঁপড়ের চাহিদা থাকায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো দিনাজপুরে উৎপাদিত পাঁপড় রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিল। পাঁপড় শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণও প্রদান করে। ২০১৬ সালে একবার পাঁপড় লন্ডনে রফতানি হয়েছিল। ভাল পরিবেশে পাঁপড় তৈরি, গুণগত মানসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি বন্ধ হয়ে যায়।
পাঁপড় বেলতে থাকা ফরিদা বেগম ও মোছাঃ আরমিনা বেগম জানান, আমরা সংসারের কাজের ফাঁকে পাঁপড় বেলি। এতে সংসারের দায়িত্ব পালনও হয় আর কিছু অতিরিক্ত টাকা আয় হয়। আবার অনেক সময় এ আয়ের ওপরই সংসার চলে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাঁপড় শ্রমিক রিনা আক্তার বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে পাঁপড় তৈরি করছি। সরকারী সহযোগিতায় আমাদের বেশ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই শিল্পে কাজ করতে আমাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। নিজে স্বাবলম্বীসহ পরিবারে সহযোগিতা করতে পারছি। এক প্রশ্নের জবাবে রিনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, আমাদের যদি সরকারী বা বেসরকারী সংস্থা সহযোগিতা করে তাহলে আমার নিজেরাই এক বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারব। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পাঁপড় তৈরি করে দেশ-বিদেশে রফতানি করতে পারব।
আমাদের গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পাঁপড় শ্রমিকদের ‘যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা’ লব্ধ গৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, এ ধরনের শিল্প নারীদের প্রেক্ষাপট ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে আরও প্রতীয়মান হয় যে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন উন্নয়ন ও লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএং) অর্জনে পাঁপড় শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দিনাজপুরের পাঁপড় শিল্প শুধু নারী শ্রম নয় উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে নারী উদ্যোগক্তা তৈরিতেও সক্ষম। আমরা আরও মনে করি যে, এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকগণ পাঁপড় তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত নারী সমাজকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের সামাজিক নিরাপত্তাসহ, স্থানীয়পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে দিনাজপুরের পাঁপড় শিল্পটির জন্য উন্মোচিত হতে পারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার।
ছবি : লেখক
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ