By: Daily Janakantha
এক হাত নেই স্টিয়ারিং ধরব কিভাবে
প্রথম পাতা
12 Jun 2022
12 Jun 2022
Daily Janakantha
নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম ॥ একটি হাত নেই। সেটিকে বারবার ইশারা দিয়ে দেখাচ্ছিলেন সীতাকুন্ড বিএম কন্টেনার ডিপোর বিস্ফোরণে মারাত্মক আঘাত পাওয়া কাভার্ডভ্যান চালক মারুফ হোসেন (২৫)। চোখের জখম কিছুটা কমেছে, তারপরও চোখ বন্ধ রেখে থেমে থেমে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। একটি কথা কানে আসছিল, ‘এক হাত তো নেই। স্টিয়ারিং কিভাবে ধরব? খুব কষ্ট পাচ্ছি ভাই। পুরো পরিবারের খাবার দেবার কেউ নেই।’ হাসপাতালে মারুফের শয্যা পাশে তার স্ত্রী পাখা করছিলেন। অবাক চোখে শুনছিলেন তার কথা। আর মারুফের মা মারজানা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, বাবা যদি ওদিন আর এক মিনিট বেশি আমার সঙ্গে কথা বলত, তাহলে ছেলেকে এভাবে পঙ্গু হতে হত না। শনিবার রাতে কল দিয়েছিল। কথা হচ্ছিল। তাকে বলছি ঘুম আসছে, তুমি যাও বাবা, খেয়ে নাও। সে জানিয়েছিল, ‘গাড়ি এখনও সিরিয়ালে। আজকেও (৪ জুন) আনলোড হবে না। সময় লাগবে। কিছুক্ষণ পরই ঘটল সেখানে ঘটনা। তখন প্রথম কল আমাকে দিছে। কিন্তু আমরা তো তখন নোয়াখালী। পরে তার বাবাকে কল দিছে।’
রবিবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় মারুফের সেবায় ব্যস্ত পুরো পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ২৫ বছর বয়সী মারুফ। তার বাবা সাহাবুদ্দিন চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম সড়কের একটি ভবনে দারোয়ানের চাকরি করেন। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনভাবে নিজের খরচটা হয়। পুরো পরিবারের ব্যয়ভার বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে হাসপাতালে কাতরানো এই মারুফের। প্রাণে বেঁচেছেন, হয়ত সেরেও উঠবেন। কিন্তু একটি হাত হারিয়েছেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চোখে-মুখে অন্ধকার।
ছোট বোনের স্বামী মোঃ রুবেল হোসেন ৪ জুন থেকেই টানা তার সেবায় নিয়োজিত। রুবেল জনকণ্ঠকে জানান, দুটো বোনের বিয়ে দিয়েছেন মারুফ ভাই। ৩ ভাই ৫ বোনের মধ্যে উনি সবার বড়। ঘটনা শুনে আমি মেডিক্যাল ছুটে আসি। কিন্তু বিপত্তি বাধে, কাউকে চিনতে পারছি না। চারদিকে পোড়া রোগীর আর্তনাদ, সারি সারি লাশ। আবার আহত রোগীরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে। পুরো হাসপাতালের হাজার হাজার মানুষ। পরে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারের সামনে দেখি একজনের কণ্ঠস্বর পরিচিত। তিনি চিৎকার করছেন, ‘আমাকে বাঁচাও, হাত তো ছিঁড়ে গেছে’।
পেশায় একটি বেসরকারী হাসপাতালের ওটি বয় রুবেল। সেই সুবাদে চমেক হাসপাতালে জানাশোনাও আছে। কিন্তু স্ত্রীর ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না কোথাও। সেই রাতের ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও জানান, একটি লোককে দেখলাম, পুরো মুখমন্ডলে রক্ত আর মুখে মারাত্মক জখম। দুই হাতের কনুইয়ের ওপরের মাংস নেই। ডান হাতের অবস্থা বেশি খারাপ। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মারুফ ভাই নাকি। উনি তখন বলছেন ‘আমি মারুফ, আমার বাড়ি নোয়াখালী, আমারে বাঁচাও।’ মূলত কণ্ঠশুনে চিনতে পারছি। পরে শনাক্ত করে ওটিতে নিয়ে গেছি।
হাসপাতালের বেডে ছটফট করা মারুফের কব্জির ওপর পর্যন্ত জখম এতই মারাত্মক ছিল যে, কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তার বিয়ের বয়স ১ বছর। প্রায় ১২ বছর আগে কাভার্ডভ্যানের হেলপার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। মামার কাছে গাড়ি চালানো শিখে বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই পুরোদুস্তর কাভার্ডভ্যান চালক। সংসারের উপার্জনকারী মারুফ আর গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে পারবেন না। চলবে কীভাবে সংসার, তাও জানেন না। পুরো পরিবার হাসপাতালে রাতদিন পালা করে তার সেবা দিচ্ছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে মারুফের। শুধু একটাই চিন্তা ‘কাটা হাতে কিছু করা যাবে তো’ না হয় পুরো পরিবার রাস্তায় নামবে।
মারুফের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সময় ডিপোর ভেতরেই ছিলেন তিনি। আশুলিয়ার নরসিংহপুরের একটি গার্মেন্টস থেকে পোশাক নিয়ে ডিপোতে আসেন। আগুনে নয়, আহত হন বিস্ফোরণে। কন্টেনার বিস্ফোরণ হওয়ার পর কয়েক মিনিট কিছুই দেখতে পারছিলেন না। পরে হাতের জখম নিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে এসে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্যের সহায়তা নেন। ওই ফায়ার কর্মী দগ্ধ ৭ জনকে একটি প্রাইভেট গাড়িতে তুলে দেন। কিন্তু বিস্ফোরণে রাসায়নিক থাকায় তাদের প্রাইভেট গাড়িটি হঠাৎ জ্বলে ওঠে কালু শাহ মাজার এলাকায়। পরে তারা গাড়িটি ছেড়ে নেমে পড়েন সড়কে। ওই রাস্তায় বসা ছিলেন মারুফসহ ৭ জন। ওই সাতজনকে একটি এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসা হয় চমেক হাসপাতালে।
হাসপাতালের করিডোরে মারুফের বাবা সাহাবুদ্দিন জানান, ছেলে কল দিয়ে সেদিন ঘটনার পর বলে, ‘বাবা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল আসো, ডিপোতে ব্লাস্ট হয়েছে’। এরপর মেয়ের জামাইকে কল দিছি। দুজন মিলে খুঁজছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। বিভৎসতায় কারও চেহারা স্পষ্ট নয়। এখন শরীরটা তার মোটামুটি ভাল। শুধু এক হাত নাই। হাসপাতালে চলে এসেছি পুরো পরিবার। পালা করে সেবা দিচ্ছি।
মারুফের পাশে থাকা রোগী মোঃ সুমনও সীতাকুন্ডের বিএম ডিপো ট্র্যাজেডির শিকার। জখম হওয়া হাতের আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বেডে ৮ দিন কাতরাচ্ছেন। হাত বুক ও চোখের আঘাত রয়েছে তার। দুই ছেলের ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। এক ঘোর অনিশ্চয়তায় থাকা এসব মানুষের কী হবে, তা জানে না কেউ।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ