By: Daily Janakantha
জোনাকির মিষ্টি আলো রাতের আঁধারে গড়ে তোলে নিসর্গ
শেষের পাতা
12 Jun 2022
12 Jun 2022
Daily Janakantha
সমুদ্র হক ॥ সন্ধ্যারাতে মিটিমিটি মিষ্টি আলোর উড়ে চলা নাচুনে ছোট্ট পোকা জোনাকি। জোনাকির আলো জ¦লে ওঠে ঝাউবনে। গ্রামে বাড়ির সামনে কোন বাগানে। কোন ধানের খেতে। নেচে নেচে মায়াবি আলোর ছন্দে এই জ্বলছে এই নিভছে। স্বপ্নময় আলোর কাব্যিক ঝিকিমিকি। দিনেরবেলায় চোখের সামনে আলোকহীন ওড়াউড়িতে চেনা যায় না। রাতে কারও হাতের তালুতে জ্বলানেভা করলে দিনের দেখা অতিচেনা পোকা রহস্য উন্মোচন করে দেয়। ছোট্ট এই পোকা পেটের শেষ প্রান্তে ঝিলিমিলি আলোর সৌন্দর্যের ভান্ডে আলোর নাচনে বাস করছে পৃথিবীতে। রাতের এমন মোহনীয়তা নিসর্গ গড়ে তোলে।
বিশ্বে জোনাকি আজও গবেষণার বিষয়। জোনাকিরা মৌমাছি থেকে অনেকটা ছোট। আকারে মেয়ে জোনাকি বড়। পুরুষ জোনাকি ছোট। আলো জ্বলে শুধু মেয়ে জোনাকির পেটের নিচ থেকে। আলো জ¦ালাতে এদের প্রচুর শক্তি লাগে। তাই এরা পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তির অধিকারী। মেয়ে জোনাকি শক্তসমর্থ সন্তান জন্ম দিতে পুরুষ জোনাকিকে প্রণয়ের আমন্ত্রণ জানায় প্রবল আলো জ্বেলে। এই আমন্ত্রণে পুরুষ জোনাকি সহজেই সারা দেয় এই ভেবে যে- স্ত্রী জোনাকি তাকে আলো জ্বালার পথ করে দেবে। এভাবে পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকির মিলনে জন্ম নেয় নব জোনাকি। তবে লার্ভার পর শিশু জোনাকির মধ্যে অনেক পরে প্রকৃতির ক্রমোজম বিভাজন করে দেয়- কে হবে পুরুষ জোনাকি আর কে হবে মেয়ে জোনাকি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় জোনাকি নিজের শরীর থেকে আলো উৎসারিত করে। এরা শিকারের উদ্দেশ্যে জ্বেলে নীলাভ আলো উৎপন্ন করে। যাতে থাকে আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাতা। বিজ্ঞানে জোনাকি ল্যাম্পরিড পতঙ্গ পরিবারের কমিওপ্টেরা প্রজাতি। জোনাকির সুন্দর একটি বাংলা নাম তমোমণি। আলো জ্বালার সময় উড়ন্ত পাখায় জ্বালানেভা করে। আলোর রং হলুদ বা ফিকে হতে পারে। কখনও হলুদের আবহে নীল মনে হবে। জোনাকির দৈর্ঘ ৫১০ থেকে ৬১০ ন্যানোমিটার। আলোর তরঙ্গ একই মাপের। পূর্ব আমেরিকায় জোনাকি নিয়ে কুসংস্কার আছে। তারা মনে করে জোনাকি জ্বালজ্বলে নীল ভূত। জোনাকির কিছু প্রজাতির নীল আলো। আলোক দৈর্ঘ্য ৪৯০ ন্যানোমিটারের নিচে।
গ্রীষ্ম ও নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় এদের বিচরণ বেশি। এরা গ্লোওয়ার্ম, ফায়ারফ্লাই, লাইটনিং বাগ নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত- জোনাকির তলপেটের কাছে আছে স্বয়ংক্রিয় নীলাভ সবুজ দ্যুতি। এই দ্যুতিতে আছে লুসিফারিন অক্সিজেন ও এটিপি সংমিশ্রণে লুসিফারেজ দ্বারা অনুঘটিত জারন; যা এদের উড়ে উড়ে আলো জ্বালাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এরা উড়ন্ত ও বসে থাকা- দুই অবস্থাতেই আলো জ্বালাতে পারে।
পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা কারণে বিশ্বে জোনাকিরা বিলুপ্ত হতে চলেছে। বলা হয়, প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জোনাকির সন্ধান পাওয়া যায় আগে। এরা এত দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে যে কোন রকমে টিকে আছে প্রায় একশ’ প্রজাতি। গ্রামের ঝোপঝাড়, ছোট গাছগাছালি কমে যাওয়ায় জোনাকির আলো ঝলমলে নাচন কমতে শুরু করেছে। যারা উঠানে ও ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলো দেখে তারা ভাগ্যবান। জোনাকিরা বংশ বাড়িয়ে টিকে থাকতে রাতের শুরু থেকেই অভিসার অভিযান শুরু করে। মেয়ে জোনাকি তীব্র আলো জ্বেলে শ্রেষ্ঠত্ব জানিয়ে আমন্ত্রণ জানায় পুরুষ জোনাকিকে। পুরুষ জোনাকি অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত উড়ে এসে মত্ত হয় মধুমিলনে।
জোনাকিরা খাদ্য জোগাতে মৃদু আলো ছাড়ে শিকার চিনতে ও সঠিক শনাক্ত করতে। তারপর নিশ্চিত হয়ে ফাঁদ বা মায়াজাল ছড়ায়। খাবারের উৎস খুঁজতে পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকি একসঙ্গে মাঠে নামে। শিকার বধ করতে স্ত্রী জোনাকি একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠির সমান জ্বলে উঠতে সক্ষম। খাদ্য খোঁজার সময় অন্যরকম ফাঁদ পাতে। সেই ফাঁদে শিকার করে শরীর থেকে জীবন রস শুষে নেয়।
জোনাকির প্রজনন বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের। নারী জোনাকির অনেক শক্তি ক্ষয় হয় বলে তারা শক্তসামর্থ্য পুরুষ সঙ্গীকে খোঁজে। এ ব্যাপারে তারা (নারী জোনাকি) খুঁতখুঁতে হয়। একসঙ্গে অধিক সন্তান ভরণ-পোষণ ইত্যাদির ব্যাপারে নারী জোনাকি হয় খুব হিসাবি। বাচ্চারা যখন শুঁয়োপোকা স্তরে তখন জোনাকি মা তাদের রক্ষার জন্য শত্রু ও লুটকারীদের বিপদ সঙ্কেত দেয় আলোর বিচ্ছুরণে।
বিশ্বে জোনাকির আলো নিয়ে কত বিচিত্রতা। কত গবেষণা। জোনাকির জীবন যুদ্ধের কথকতা। জোনাকির সব সৌন্দর্য মেয়েদের। কাজও ওদের বেশি। শুধু মেয়েরাই জ্বলে আর নিভে শরীর থেকে শরীর উৎপন্ন করে। লালনপালন করে। জোনাকির আলো জ্বলে ওঠে রাতের পরশ পেয়ে।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ