By: Daily Janakantha
প্রশিক্ষণ- তিন কিশোরী ফুটবলারের পর্তুগাল যাত্রা
খেলার ফিচার
11 May 2022
11 May 2022
Daily Janakantha
ফুটবলপাগল নান্দাইলের তিন অদম্য কিশোরী স্বপ্না আক্তার জেলি, সিনহা জাহান শিখা ও তানিয়া আক্তার তানিসা। বঙ্গমাতা অনুর্ধ-১৭ নারী ফুটবলের সেরা খেলোয়াড় এই তিন কিশোরী ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর দেশ পর্তুগালে উড়ালের অপেক্ষায় দিন পার করছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিদফতর অয়োজিত বঙ্গমাতা নারী ফুটবলের সেরা ৪০ কিশোরী খেলোয়াড়কে নিয়ে বিকেএসপিতে দুই মাসের ক্যাম্প করে। এখান থেকে গড়া একটি দল উন্নত প্রশিক্ষনের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছে। আর এই দলেই জায়গা করে নিয়েছে নান্দাইলের জেলি, স্বপ্না ও তানিসা। এমন খবরে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে গোটা নান্দাইল। আনন্দে আত্মহারা এই তিন ফুটবলারের পরিবার ও কোচ মকবুল হোসেনসহ এলাকার নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। কোচ মকবুল হোসেন জানান, অনেক কষ্ট করে নান্দাইলের এই তিন ফুটবলার বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছে শক্তির কারণেই এই সাফল্য এসেছে তারা।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের ইলাশপুর গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক ফয়েজ উদ্দিন ফকির ও গৃহিনী মাতা সুরাইয়া বেগমের কন্যা স্বপ্না আক্তার জেলি। সাত ভাইবোনের মধ্যে স্বপ্না ছয় নম্বর। নান্দাইল পাইলট গার্লস স্কুলের অস্টম শ্রেণীর ছাত্রী স্বপ্নার ফুটবলযাত্রা বাড়ির পাশের পাচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ফুটবলের প্রতি আগ্রহ দেখে হতদরিদ্র বাবা-মা মেয়েকে উৎসাহ দিলেও বাধার মুখে পড়ে স্বপ্না মাদ্রাসাছাত্র বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।
খেলার পোশাক নিয়ে গ্রামবাসীরও অনেক কটু কথা শুনতে হয় স্বপ্নাকে। এসব কটত কথা আর পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে চরম অভাব-অনটনের মধ্যেও প্র্যাকটিস চালিয়ে যায় অদম্য স্বপ্না। নিজ বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার কাঁচা সড়ক হেঁটে পাচরুখী বাজার। সেখান থেকে প্রতিদিন নান্দাইল সদরের যাতায়াত ভাড়া ৬০ টাকা। বাবা-মা হাঁস-মুরগি বিক্রি করে এর জোগান দিয়েছেন। যে দিন ভাড়ার টাকা থাকত না, সেদিন প্র্যাকটিস বন্ধ। বর্ষায় দেড় কিলোমিটার কাঁচা সড়ক এবং ১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক পাড়ি দিতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে তাকে। এই ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহীন ও কোচ মকবুল হোসেন স্বপ্নাকে আন্তরিকভাবে সহায়তা দিয়েছেন বলে জানায় স্বপ্না। মা সুরাইয়া জানান, অনেক সময় মেয়েকে ভাড়ার টাকা দিতে পারিনি। এটা সেটা বিক্রি করে ভাড়ার টাকা জোগাড় করে দিলেও বেশিরভাগ সময় খাবার দিতে পারিনি- জানান সুরাইয়া। সামান্য বাড়িভিটা আর সামান্য ফসলি জমি সম্বল। প্রথম দিকে এলাকার নানাজন কটত কথা বললেও স্বপ্নার পর্তুগাল যাওয়ার খবরে সবার ভোল পাল্টে গেছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রায় প্রতিদিনই নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বপ্নার খোঁজ নিতে আসছে। কবে ফ্লাইট, কতদিন থাকবে পর্তুগাল জানতে আসছে তারা। স্বপ্না আক্তার জানায়, স্কুল থেকেই খেলার আগ্রহ জন্মে তার। প্রতিনিয়ত টাকা পয়সার সমস্যা থাকলেও স্বপ্না দমে যায়নি। তবে এত দূর যাওয়া সহজ ছিল না। একান্ত ইচ্ছাশক্তির কারণেই সেটি সম্ভব হয়েছে বলে জানায় স্বপ্না। লোকে কটু কথা বললেও আজ আর কোন দুঃখ নেই। স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে ভেবে যারপর নেই খুশি সে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অনেকের খেলাই স্বপ্না অনুসরণ করার কথা উল্লেখ করে জানায়, একদিন লাল-সবুজের জার্সি পরে বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলবে এমন দৃঢ় বিশ্বাস তার।
মা বেঁচে নেই। বাবা বিপ্লব মিয়া আবার বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। ৩ বোন আর ১ ভাইয়ের মধ্যে শিখা ৩ নম্বর। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মারা যায় মা। সেই ছোটবেলা থেকেই নানার বাড়িতে বড় হয়েছে আরেক অদম্য ফুটবলার সিনহা জাহান শিখা। নান্দাইল উপজেলার সেরপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়া গ্রামের বিধবা নানির সঙ্গেই থাকছে শিখা। এক চিলতে টিনের ঘর। গ্রিল না থাকায় ঘরের পেছনের খিড়কি খোলা থাকে সব সময়। টিনের চাল জরাজীর্ণ। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে ঢেকে রাখা হয়েছে মোটা কাপড় দিয়ে। নানির আয়-রোজগার বলতে হাঁস-মুরগি পালন।
আর এই হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করেই এত দূর আসা। এ কষ্টের যেন শেষ নেই। নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। শিখা খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি ফুটবল প্র্যাকটিস করত। নান্দাইল পাইলট গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী শিখা জানায়, অভাব-অনটন আর গ্রামবাসীর নানা কটু কথায় সে দমে যায়নি। নানি হালিমা জানায়, এই কষ্টের সীমা নেই। এত অভাবের মধ্যেও নাতনি শিখার অদম্য ইচ্ছে শক্তির কারণেই সে এগিয়ে গেছে। খাবারও জুটত না অনেক সময়। স্কুলে যাওয়ার আগে কিংবা খেলার পরও ছিল না ভাল খাবারের কোন সংস্থান। স্থানীয় পাচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই শিখা ফুটবলের প্রতি আসক্ত। পরিবার থেকে কোন বাধা না আসলেও খেলার পোশাক পছন্দ ছিল না গ্রামের কারও।
পর্তুগাল যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে- এমন খবরে ঘুম ভেঙ্গে গেছে এলাকাবাসীর। প্রতিদিন দল বেঁধে শিখার বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন গ্রামবাসী। এসব দেখে সব দুঃখ, কষ্ট এখন ভুলে গেছে শিখা ও তার নানিসহ পরিবার। আবেগাপ্লুত ও মহাখুশি শিখা জানায়, ভবিষ্যতে আরও এগুতে চাই। জাতীয় দলের হয়ে একদিন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে খেলবে শিখা- এমন প্রত্যয় চোখেমুখে। এখন চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি তারা ঠিকঠাক মতো পর্তুগাল যেতে পারলে খেলোয়াড়ী জীবনের বড় একটা সিড়িঁ অতিক্রম করতে পারবে তারা।
স্বপ্না আর শিখার মতোই একই ফ্রেমে বাঁধা আরেক অদম্য কিশোরী ফুটবলার তানিয়া আক্তার তানিসার গল্প। তানিসাও নান্দাইল পাইলট গার্লস হাইস্কুলের অস্টম শ্রেণীতে পড়ছে। নান্দাইল উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কতুবপুর গ্রামের টমটমচালক বাবা দুলাল মিয়া ও গৃহিনী মা মজিদা খাতুনের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট তানিসা। অভাব আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী তানিসার। থাকার জন্য নিজের কোন ঘর নেই।
গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় স্কুলের বড় আপাদের খেলা দেখে ফুটবলের প্রেমে পড়ে তানিসা। বঙ্গমাতা ফুটবল খেলা দেখতে বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের নান্দাইল পাইলট গার্লস হাইস্কুলে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া ছিল না। পায়ে হেঁটেই যেত হত।
বর্ষায় ভোগান্তি ছিল অসহনীয়। তারপরও খেলা দেখতে যাওয়া। বাবা-মা হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রির টাকা থেকে মাঝে মধ্যে ভাড়ার টাকা জোগান দিলেও তানিসাকে খেয়ে না খেয়ে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে খেলার পোশাক পরে আসা-যাওয়ার পথে ছিল নানা রকমের কটূক্তি, বিদ্রুপ। এখন সবাই ভোল পাল্টে সমর্থন জোগাচ্ছে। প্রতিদিন তানিসার বাড়িতে ভিড় করছেন এলাকাবাসীসহ আশপাশের অসংখ্য মানুষ। তানিসাও একদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখছে। পর্তুগাল যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে ভীষণ খুশি তানিসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহীন, কোচ মকবুল হোসেনসহ শিক্ষকম-লী এবং এলাকাবাসীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
The Daily Janakantha website developed by BIKIRAN.COM
Source: জনকন্ঠ