মাত্র আট বছর আগেও কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে এক নগণ্য চায়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন মো. ফরিদ, যিনি বর্তমানে ‘চিয়ক ফরিদ’ নামে পরিচিত। সংসার চালাতে তার স্ত্রী শাহিনা আক্তার কাজ করতেন চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টসে। জীবনের শুরুটা ছিল অভাব-অনটনে ভরা। অথচ সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন সীমান্তঘেঁষা ইয়াবা কারবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। দৃশ্যমান কোনো বৈধ ব্যবসা না থাকলেও চিয়ক ফরিদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, বহুতল ভবন, জমি, বিলাসবহুল গাড়ি, আর জীবনযাত্রায় বিদেশি আভিজাত্যের ছাপ।ফরিদ, পিতা মৃত ছৈয়দ মোস্তফা ও মাতা দিলারা বেগম দম্পতির ছেলে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বালুখালীর জুমের ছড়ায়। দিনমজুর পিতার আয়েই চলত পরিবার। দারিদ্র্যের কারণে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ার সুযোগ হয়নি। কর্মজীবনের শুরু চায়ের দোকানে খুদে সহকারী হিসেবে। পরে হন ক্যাশিয়ার। সেই সময় স্ত্রী শাহিনা আক্তারও গার্মেন্টসে কাজ করে সংসারে সহযোগিতা করতেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলছিল তাদের সংগ্রামী জীবন।এরপর হঠাৎ বদলে যায় সব। ফরিদ জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা কারবারে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই সময় থেকেই শুরু হয় ফরিদের অপরাধজগতের উত্থান। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি গড়ে তোলেন বিপুল সম্পদের পাহাড়।অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে ‘ফয়সাল গেস্ট হাউস’, ‘হাঁড়ি রেস্টুরেন্ট’, উখিয়ায় আলু গোলা মাঠ এলাকায় চার কোটি টাকার জমি, বক্তার মেম্বারের বাসার পাশে একটি বহুতল ভবন, বাইশারিতে ৩২ একর জমির আমবাগান, ডাকবাংলোর সামনে একাধিক প্লট, দুটি ডাম্পার ট্রাক, দুটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাডো গাড়ি তার মালিকানাধীন।চলাফেরায় বিলাসবহুল গাড়ি ও পোশাকে বিদেশি আভিজাত্য- তবুও নেই কোনো বৈধ ব্যবসা কিংবা আয়ের উৎস। স্থানীয়দের ভাষায়, ফরিদের আর্থিক উত্থান পুরোটাই ইয়াবার টাকায়।র‌্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন প্রশাসনিক সূত্র জানায়, ফরিদের বিরুদ্ধে উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও দেশের বিভিন্ন থানায় ডজনখানেক মাদক ও অপহরণ মামলা রয়েছে। তবুও তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক ছলচাতুরির অভিযোগ।চিয়ক ফরিদ কেবল স্থানীয় মাদক ডিলার নন, তিনি মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা আমদানির অন্যতম নিয়ন্ত্রক। প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, ইয়াবার চালান ফরিদের নির্দেশেই নাফ নদী পেরিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করে, সেখানেই গুদামজাত হয়ে পরে তা ছড়িয়ে পড়ে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায়। তার সিন্ডিকেটে রয়েছে রোহিঙ্গা বাহক, অস্ত্রধারী গোষ্ঠী, ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি ও এনজিও-সংযুক্ত সুবিধাভোগী একটি শক্তিশালী চক্র।স্থানীয়রা বলছেন, ফরিদ যেন উখিয়ার ‘দাউদ ইব্রাহীম’। কখনো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছায়ায় থেকেছেন, আবার সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের আভাস পেলে বিএনপির নেতাদের কাছে কোটি টাকার অনুদান দিয়ে সম্পর্ক গড়ছেন। এক সাবেক যুবদল নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়েও এলাকায় চলছে আলোচনা।পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তথ্য তো আমাদের হাতেও আছে। কিন্তু উপরের চাপ আছে। ফরিদের পেছনে রাজনৈতিক হাত না থাকলে এতদিনে সে কারাগারে থাকত।’সরকারি বাজার ইজারা, ত্রাণ বিতরণ, ঘর নির্মাণ ও এনজিও পণ্য নিয়ন্ত্রণে ফরিদের ‘লোক’ জড়িত। অর্থাৎ ইয়াবা টাকায় বৈধ ব্যবসায় রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা এখন তার অন্যতম কৌশল। এমনকি ফরিদ একটি পুরনো রোহিঙ্গা নারীকে বিয়েও করেছেন, যার মাধ্যমে সীমান্ত ও ক্যাম্পে ‘ডিল’ সহজ হয় বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে।তথ্য বলছে, গত ১ জুলাই বিজিবির হাতে ফরিদের দুই সহযোগী ৫০ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়লেও, মামলার চার্জশিটে ফরিদের নাম নেই। স্থানীয় সূত্র জানায়, সোর্স রাসেলের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকার লেনদেনে ফরিদ মামলার তালিকা থেকে বাদ পড়েন। যার মধ্যে ৮ লাখই যায় সংশ্লিষ্ট বিজিবির কথিপয় সদস্যদের পকেটে।সূত্রের দাবি, ওইদিন রাতে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ফরিদের একটি বড় ইয়াবা চালান দেশে প্রবেশ করছিল। মোট ৫০ কার্ড ইয়াবার সেই চালানটি সামলাচ্ছিল ফরিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মনির। কিন্তু পথে মনির গোপনে সেখান থেকে পাঁচ কার্ড ইয়াবা সরিয়ে নেন। বিষয়টি টের পেয়ে দুজনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে প্রতিশোধপরায়ণ ফরিদ পুরো চালানটি বিজিবিকে ধরিয়ে দেন এবং মামলায় মনিরকে প্রধান আসামি হিসেবে জড়ান। এই ঘটনায় ইয়াবা বহনের সঙ্গে যুক্ত দুই রোহিঙ্গা যুবকও গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাভোগ করছেন।একজন মুদি দোকানদার বলেন, ‘আগে ফরিদ ভাই চায়ের দোকানে কাজ করতেন, এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। হঠাৎ এত টাকা কোথা থেকে আসলো?’এক নারী উন্নয়ন কর্মী বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা টাকা দিয়ে সমাজে ‘ভদ্রলোক’ সেজে বসলে সেটা আরও ভয়ঙ্কর হয়।’একজন প্রবীণ মুরব্বি বলেন, ‘ভাই ক্রসফায়ারে মরল, টার্গেট ছিল ফরিদ। এখন সে বৈধ ব্যবসায়ী সাজছে!’১৭ ফেব্রুয়ারি ফরিদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গাড়িসহ কিছু মালামাল জব্দ করে পুলিশ, কিন্তু ফরিদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। বিজিবি’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, তবে সিন্ডিকেট খুবই সূক্ষ্ম।’ফরিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় দেওয়ার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।স্থানীয়দের মতে, চিয়ক ফরিদের উত্থান একটি দুর্বিনীত রাষ্ট্রীয় কাঠামো, দুর্বল প্রশাসন ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ কিভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে তার প্রতিচ্ছবি। যতদিন ফরিদের মতোদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হবে, ততদিন সীমান্তে শুধু ইয়াবা নয়, থাকবে ভয়, সহিংসতা ও আইনের প্রতি জনগণের অনাস্থা।এনআই

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
টাকার বিনিময়ে নাগরিক তথ্য পাচারের অভিযোগে ২ কর্মচারী আটক
টাকার বিনিময়ে নাগরিক তথ্য পাচারের অভিযোগে ২ কর্মচারী আটক

টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য পাচারের অভিযোগে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা নির্বাচন কমিশন অফিসের দুই কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। বুধবার (১৯ Read more

বিমানবন্দর থেকে ১২৩ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া
বিমানবন্দর থেকে ১২৩ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ১২৩ বাংলাদেশিসহ ১৯৮ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। সঙ্গে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা, আবাসন Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন