‘মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ের বাদ্য আলা বাজে রে / মালকার বিয়া হইলো মনু মিয়ার সাথে রে…’ বাংলার জনপদে বহুল প্রচলিত এই লোকগান শুনেননি এমন মানুষ বিরল। কিন্তু এই গানের পেছনের ইতিহাস ও চরিত্রদ্বয়ের পরিচয় হয়তো অনেকেই জানেন না। ইতিহাসের পাতায় যাঁরা চোখ রাখেন, তাঁরা জানেন এই গানের অন্তরালের কাহিনি জানা যায় মনু মিয়া ও মালকা বানুর প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ এবং ভালোবাসার অমর নিদর্শনের কথা।এই কাহিনির সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ‘মনু মিয়া জামে মসজিদ’। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন।বাংলার সুবেদার মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ শুজার সেনাপতি ছিলেন শেরমস্ত খাঁ। তাঁরই পুত্র জবরদস্ত খাঁ, যিনি পরে ‘মনু মিয়া’ নামে পরিচিতি পান। তিনি চট্টগ্রামের কাট্টলীর জমিদার দেওয়ান বদিউজ্জামানের বোন খোরসা বানুকে বিয়ে করেন। কিন্তু প্রথম স্ত্রী খোরসা বানু ছিলেন নিঃসন্তান। পরে তিনি দ্বিতীয়বার বাঁশখালীর সরল গ্রামের মালকা বানুকে বিয়ে করেন। তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান।মনু মিয়ার মৃত্যু হলে মালকা বানু ফিরে যান বাবার বাড়িতে। আর মনু মিয়ার স্মৃতি হয়ে টিকে থাকে তাঁর জীবদ্দশায় নির্মিত মসজিদটি, যা তিনি প্রথম স্ত্রী খোরসা বানুর নামে নির্মাণ করেন। মনু মিয়া মৃত্যুবরণ করার পর তাঁকে দাফন করা হয় কাছের কাজীর পাহাড় এলাকায়।‘মনু মিয়া মসজিদ’ মুঘল আমলের শেষদিকে নির্মিত হয়। এটি ২০x৪০ ফুট আয়তনের। মসজিদের প্রধান গম্বুজটির সঙ্গে আরও কয়েকটি ছোট গম্বুজ যুক্ত রয়েছে। পুরো মসজিদজুড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নকশা ও কারুকাজ। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের উদ্যোগে এর টালি সংযোজন ও আংশিক সংস্কার করা হয়।মসজিদের খেদমতে থাকা মুয়াজ্জিন এনামুল হক চৌধুরী জানান, ‘এই মসজিদকে ঘিরে নানা অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছি। অনেকে বলেন, মাঝরাতে এখানে গুনগুন করে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শোনা যায়, কিন্তু কাছে গেলে সেই আওয়াজ আর পাওয়া যায় না। আবার রাতের বেলায় মসজিদের পাশে কবরস্থানে আলোর ঝলকানি দেখা যায়।’স্থানীয় বাসিন্দা জাগির আহমদ বলেন, ‘অনেক বছর আগে খেজুর গাছে রস তুলতে গিয়ে দেখেছিলাম পুরো মসজিদ আলোকিত হয়ে আছে। অথচ সেই আলো কোনো বৈদ্যুতিক বাতির নয়। বাবাকে ডেকে এনে দেখাই, কিন্তু তখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।’মসজিদের খতিব কাজী নুরুল আবছার বলেন, ‘এখানে অনেকেই মানত নিয়ে আসেন। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে নিজেদের নিয়ত নিয়ে। অনেকেই ফিরে যান সমাধান পেয়ে। আমি এখানে তিন বছর ধরে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, এবং বহু অলৌকিক কাহিনি শুনেছি।’মসজিদটির বর্তমান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ফরিদুল হক চৌধুরীর বংশধরেরা। তাঁদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এখনও সেখানে নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় কার্যক্রম নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘মনু মিয়া জামে মসজিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর ইতিহাস, স্থাপত্য ও লোককাহিনি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এই মসজিদের ২০১০ সালে টালি সংযোজন ও আংশিক সংস্কার করেন।’
Source: সময়ের কন্ঠস্বর