২০১৯ সালের ঘটনা। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। বাড়ির পাশে ঝড়ে পড়া আম কুড়াতে বেরিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ঝুমুর ও তার দুই মামাতো বোন। আম কুড়িয়ে দুই মামাতো বোন ঘরে ফিরে এলেও ঝুমুর আর ফিরল না। পরে বাড়ির পাশের খালপাড়ে তার বিবস্ত্র মরদেহ পাওয়া যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল পানিতে ডুবে গেছে, কিন্তু স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এটি ধর্ষণ ও হত্যা। সোর্স মারফত খবর পেয়ে থানায় জানাই, নিজেও যাই ঘটনাস্থলে। সরেজমিনে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিকাল ৩টা নাগাদ রিপোর্ট লেখা শেষ করি। তখনো পেটে একটা দানা পরেনি। সঠিক সময়ে সংবাদ পাঠানোর চিন্তায় ক্ষুধা নামক বিষয়টি যেন নিজের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে। সংবাদ প্রেরণে দেরি হলেই পিছিয়ে যাবো এমন ভাবনা থেকেই এ অস্থিরতা। কারণ তখনো কোনো বড় মিডিয়ায় খবরটি আসেনি, তাই নিজেকে এগিয়ে রাখতেই এ প্রচেষ্টা। সংবাদ লেখা শেষ, এবার মেইল করার পালা। এমন সময় দেখি মোবাইল ডাটা কাজ করছে না। বাধ্য হয়ে সিম পরিবর্তন করে রিচার্জ করে প্রেরণ করি। ততক্ষণে বিকাল ৫টা। এর মধ্যেই কিছু বড় মিডিয়ায় খবরটি প্রকাশিত হয়। এমন অভিজ্ঞতা আরও অনেক আছে যা বলে শেষ করা যাবে না।এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়, সারাদেশে যারা মফস্বলে সাংবাদিকতা করেন তাদের সবারই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দিনরাত এক করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিবারের প্রিয়মুখগুলোও একসময় ভাবনার বাইরে চলে যায় তাদের। ভাবনায় থাকে শুধু দ্রুততম সময়ে ঘটনার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য নিজ হাউজে প্রেরণ করা। কাজ শেষ হলেই অনুভব করি নিজের শরীরটা জানান দেয় আমি ক্লান্ত। তবে এ ক্লান্তি দূর হতে বেশি সময় লাগে না যখন তাদের চোখে পড়ে নিজের করা সংবাদটি নিজের কর্মস্থলে গুরুত্বসহ প্রকাশ করেছে।মফস্বলে যারা সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত তারা কোনো মাসিক বেতনের আশায় কাজ করেন না। তাদের অধিকাংশেরই নেই নির্ধারিত বেতন কাঠামো, নেই নিজ কর্মের প্রশংসনীয় মূল্যায়ন। রিপোর্ট ছাপা হলেও অনেকে জানেন না কে রিপোর্টার! তবু তারা কাজ করেন। কেন? কারণ শুধু একটাই, দেশের মানুষকে সুন্দর এক আগামী উপহার দেওয়ার জন্য। তাদের বিশ্বাস—‘সত্য বলার কাজটা কাউকেই তো করতে হবে।’এ পেশায় যারা রাজধানী ঢাকায় স্বনামধন্য হাউজগুলোতে যুক্ত আছেন, তাদের যত সহজে কাজের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি পান, মফস্বলে তার পুরো বিপরীত চিত্র। ভালো মানের কাজ করেও অনেক সময় তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। অথচ এই মানুষেরাই প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে পড়েন, কখনো ভাঙা সাইকেল চালিয়ে, কখনো বা হেঁটে। সংবাদের নেশা তাদের রক্তে। কঠোর শ্রমে তুলে আনা এ সংবাদকর্মীকেই দিন শেষে বলা হয় ‘ও তো লোকাল রিপোর্টার!’তাদের হাতে পত্রিকার কার্ড থাকে, কিন্তু পকেট খালি। থানায় গেলে পুলিশ প্রশ্ন করে, “আপনি কি সত্যিই সাংবাদিক?” স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন, “আপনার অফিস জানে আপনি রিপোর্ট করছেন?” আর জাতীয় মিডিয়ার কেউ পরিচয় দিলে যত সহজে স্বীকৃতি মেলে, একজন মফস্বল প্রতিনিধি তখনো ‘উপজেলা থেকে রিপোর্ট পাঠানো লোক’ হিসেবেই থেকে যান।আমার নিজের অভিজ্ঞতা, মফস্বলে কাজ করার সময় না ছিল সফটওয়্যার, না ছিল মিডিয়া ট্রেনিং। মোবাইলেই ছবি, মোবাইলেই টাইপিং। আর আজ আমি রাজধানীর একটি গণমাধ্যমের মাল্টিমিডিয়া বিভাগের প্রধান, ক্যামেরা, স্টুডিও, আলো, সম্পাদনার সবকিছু হাতে। কিন্তু প্রতিদিনই মনে পড়ে সেই মানুষগুলোকে, যারা এখনো কষ্টের ভিতরেই সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন।আজ যখন ঢাকায় অফিসে বসে প্রতিনিধিদের রিপোর্ট এডিট করি, তাদের ফাইল দেখি, তখন মনে হয়—এই প্রতিটি নিউজের পেছনে একটা ছোট গল্প আছে, কিছুটা ঘাম, কিছুটা ভেজা চোখ, কিছুটা অবহেলা। এই মানুষগুলো ছাড়া কোনো গণমাধ্যমই জাতীয় হতে পারে না। কারণ রাজধানীতে বসে গ্রামবাংলার সমস্যা তুলে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ত্রাণ বণ্টনে অনিয়ম, স্থানীয় রাজনীতির গোষ্ঠী সংঘাত, নদীভাঙা, নারী নির্যাতন, জেলার মানুষের ভোগান্তি—এসব খবরে প্রথম হাত রাখেন এই প্রতিনিধিরাই।তাই কিছু প্রশ্ন ওঠা জরুরি। যেমন- • আমরা কি মফস্বলের সাংবাদিকদের যথার্থ মূল্যায়ন এবং মর্যাদা দিতে পেরেছি? • তাদের নিয়মিত সম্মানী নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি?• নিরাপত্তা ও আইনিসহায়তা নিশ্চিতে কি কেউ ভেবেছি?• প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে টেকসই কোন ব্যবস্থা কি গ্রহণ করতে পেরেছি?যদি উত্তর হয়—“না” তবে আমাদের স্লোগানগুলো, ‘সত্যের পক্ষে’ বা ‘গণমানুষের কণ্ঠস্বর’—এসব কেবল পোস্টারের ভাষায় আটকে আছে।আমি জানি, শহরের এই এয়ারকন্ডিশন্ড অফিস রুমে বসে যে স্বাচ্ছন্দ্য, তার শেকড় সেই উপজেলা প্রেসক্লাবে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে জাতীয় হতে চাই, তবে মফস্বলের প্রতিনিধিদের শুধু “খবরের উৎস” নয়, বরং সহযোদ্ধা এবং গণমাধ্যমের ভিত্তি হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানেই গণমাধ্যমের ভবিষ্যতের ভিতকে আরও শক্ত করে গড়ে তোলা।লেখক- মাল্টিমিডিয়া ইনচার্জ, সময়ের কণ্ঠস্বর

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
বেড়েই চলছে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ
বেড়েই চলছে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ

রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৮৮৯ কোটি Read more

টিভিতে আজকের খেলা
টিভিতে আজকের খেলা

প্যারিস অলিম্পিক সরাসরি, সকাল ১১টা;

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন