চট্টগ্রামের বুক চিরে প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়ানো ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সারি এখন এই নগরের গলার কাঁটা। বন্দরের প্রবেশপথ এবং আশপাশের এলাকায় তৈরি হচ্ছে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার যানজট। ট্রাফিক বিভাগের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে দিনের যেকোনো সময়েই ভারী যানবাহন ঢুকে পড়ছে শহরের অভ্যন্তরে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্বিষহ জনদুর্ভোগ, বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার্থীর শিক্ষা, রোগীর চিকিৎসা এবং অফিসগামীর সময়ানুবর্তিতা।অলংকার মোড়, কদমতলী, মাদারবাড়ি, সল্টগোলা ক্রসিং, রশিদ বিল্ডিং, নিমতলা বিশ্বরোড–নামগুলো যেন এখন যানজটের সমার্থক। ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের তীব্র চাপের কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব এলাকায় রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ছে যান চলাচল। বন্দরমুখী এ যানজটে আটকে থাকছে স্কুলবাস, অ্যাম্বুলেন্স, অফিসযাত্রী বাস, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িও। গত সপ্তাহের রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত যানজটের তীব্রতা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে অনেক পরীক্ষার্থী যথাসময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে কষ্ট হয়ে গেছে।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের বিধি অনুযায়ী, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নগরীতে কোনো ধরণের ভারী যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। এদের জন্য রয়েছে বিকল্প সড়ক–পোর্ট কানেকটিং রোড, টোল রোড, আউটার রিং রোড। কিন্তু বাস্তবে বন্দরের যানবাহনগুলো অলংকার হয়ে নগরীর কেন্দ্রস্থলে ঢুকে পড়ছে এবং দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ও কদমতলী হয়ে বন্দরের গেটে ঢুকছে। আর এই পথেই তৈরি হচ্ছে যানজটের দীর্ঘ লাইন।ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মতে, বন্দরগেট এলাকায় প্রতিটি গাড়িকে থেমে অনলাইন পাস নিতে হয় এবং তল্লাশি করতে হয়। এতে প্রতিটি গাড়ির পেছনে গড়ে ৩-৫ মিনিট সময় লাগে। এই অপেক্ষার সময়েই আরও বহু গাড়ি এসে সারিতে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে পুরো এলাকা রূপ নেয় স্থবির এক যানজটে।অনলাইন গেটপাস সিস্টেম চালু করে বন্দরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘জট নয়, গতি আসবে।’ বাস্তবে হয়েছে উল্টো। পাস সিস্টেমে সার্ভার সমস্যার কারণে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দণ্ডায়মান থাকতে হচ্ছে গাড়িগুলোকে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে মূল নগরজীবনে।বর্তমানে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানগুলো কদমতলী হয়ে রশিদ বিল্ডিং এবং দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ব্যবহার করে বন্দরে যাচ্ছে এবং একই পথ হয়ে ফিরে আসছে। এতে করে উভয়মুখী ট্রাফিক চাপ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–নির্ধারিত বাইপাস রুট ব্যবহার না করে কেন শহরের মধ্যভাগ দিয়েই চলছে এসব গাড়ি?ট্রাফিক পুলিশের দাবি, তারা শুধু সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছে। তারা বলেন, রুট নির্ধারণ ও যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া তাদের এখতিয়ারে নয়। কদমতলী ট্রাফিক পুলিশ বক্সে কর্তব্যরত এক সার্জেন্ট বলেন, “গাড়ি থামিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ঢোকা বন্ধ করতে পারি না। সেখানে বন্দরের অনুমতি আছে।” এই অবস্থান নগরবাসীর কাছে ট্রাফিক বিভাগের নির্লিপ্ততা হিসেবেই ধরা পড়ছে।বন্দরের আশেপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) এবং পর্যাপ্ত ট্রাক টার্মিনালের অভাব এই সঙ্কটকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পণ্য লোড-আনলোডের জন্য এ গাড়িগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা পার্কিং করে থাকে বিভিন্ন সড়কে। এতে করে বিমানবন্দর সড়ক, আউটার রিং রোড, মাঝিরঘাট, টোল রোড—সব সড়ক পরিণত হয়েছে অস্থায়ী টার্মিনালে।সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসফিকুজ্জামান আকতার সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, “বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ’র অনুরোধে কিছু রপ্তানিমুখী গাড়িকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রয়েছে।”কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে, এই অনুমতির সুযোগ নিয়েই শহরের অভ্যন্তরে ঢুকছে অসংখ্য ট্রাক, যাদের অধিকাংশেরই সংশ্লিষ্টতা রপ্তানির সঙ্গে নেই।চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, “নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ১২-১৫ হাজার ভারী যান চলাচল করে। আগে তারা নিদিষ্ট রুট–নিমতলা থেকে পিসি রোড হয়ে চলাচল করত। পরবর্তীতে চাপ সামলাতে ফৌজদারহাট থেকে টোল রোড চালু হয়। কিন্তু এখন নিয়ম উপেক্ষা করে সবাই শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহণ মালিক সংগঠনের মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা থাকায় সমস্যা প্রকট হচ্ছে।”তিনি বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীরা একাধিকবার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি, যেমন–টার্মিনাল স্থাপন, ডিপোর স্থান নির্ধারণ, সময়ভিত্তিক পারমিশন ইত্যাদি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা না থাকলে উন্নয়ন কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে।”নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রামের বন্দর-নির্ভর অর্থনীতি দেশের রপ্তানির প্রধান চালিকাশক্তি হলেও তার ধারক শহরটি আজ নিজ ভারেই নুয়ে পড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল, পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো এবং দায় এড়ানো মনোভাব–এই তিনটি কারণেই নগরবাসী প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছে।এই সংকট শুধু ট্রাফিক কিংবা বন্দর বিভাগের ব্যর্থতা নয়–এটি একটি সমন্বয়হীন রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি। অবিলম্বে সমস্যাটি সমাধানে উদ্যোগ না নিলে এই যানজট শুধু রাস্তায় নয়, থেমে যাবে দেশের রপ্তানি সম্ভাবনাও। এফএস
Source: সময়ের কন্ঠস্বর