ময়মনসিংহ শহরের চরকালীবাড়ি এলাকায় রাত নামলেই শুরু হয় পুরোনো ব্যাটারি পোড়ানোর কাজ। গোপনে কারখানায় পুরনো ব্যাটারি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় সীসা। ব্যাটারির অ্যাসিডমিশ্রিত প্লেট চুল্লিতে ফেলে পোড়ানোর সময় আকাশে মিশে যায় কালো ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ায় বিষ ঢুকে পড়ছে বাতাসে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ, ভুগছেন সাধারণ মানুষ।স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সৃষ্ট দূষণে এলাকায় শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা, মাথাব্যথা এবং নানা অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। তারা জানান, জানালা খোলা রাখা যায় না, ধোঁয়া আর দুর্গন্ধে নিশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর।স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কারখানার মালিক মো. মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা মো. সারোয়ার হোসেন মন্ডল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। বড়ভাই ফজলুল হক মহানগর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। আর মোশাররফ নিজে ময়মনসিংহ-৪ আসনের সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্তর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেই এতদিন ধরে কারখানা পরিচালনা করে আসছে মোশাররফ, দাবি এলাকাবাসীর।সংশ্লিষ্টদের দাবি, ব্যাটারি পোড়ানোর এই প্রক্রিয়ায় নির্গত ধোঁয়ায় রয়েছে সীসাসহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। এতে মানুষের রক্ত, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষতি হয়। কৃষিজমিতে কমে যায় ফসল উৎপাদন। মরে যাচ্ছে মাছ ও গবাদিপশু।অবৈধ কারখানায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চরকালীবাড়ি এলাকার ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে ‘মন্ডল করপোরেশন’ নামে একটি সীসা তৈরির কারখানা। এটি অবস্থিত ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের পাশে, নগরীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চায়না মোড় এলাকায়। প্রতিদিন এই কারখানায় পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে ভেতরের পাত (প্লেট) বের করে তা কাঠ ও কয়লার চুল্লিতে পোড়ানো হয়। প্লেটগুলোতে থাকে অ্যাসিড ও অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান। শ্রমিকরা জানায়, আগুন জ্বালিয়ে সেই প্লেট গলানো হয় এবং বৈদ্যুতিক পাখার সাহায্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর মাধ্যমেই উৎপাদিত হয় সীসা।চরকালীবাড়ি, চরঝাউগড়া, চরগোবদিয়া, শম্ভুগঞ্জ বাজার, রঘুরামপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ জানান, কারখানার কালো ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে খোলা রাখা যায় না জানালা। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, ত্বকের সমস্যা ও নানা অজানা রোগে।চরকালীবাড়ি এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘কারখানা চালুর পর থেকে জীবনই ওষ্ঠাগত। খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে।’উদ্বেগ প্রকাশ করে আনন্দ মোহন কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ফাহমিদা ইয়াসমিন জানান, ‘সীসা বাতাসে উড়ে সরাসরি পরিবেশে মিশে যায়, এরফলে গাছের পাতা ঝরে যায়। গাছে ফল আসলেও তা টিকে না। ফসলের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।’তিনি আরও জানান, এসব কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বাতাসে সীসা, সালফিউরিক অ্যাসিড, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন ভারী ধাতু ছড়ায়, যা বাতাস, পানি ও মাটিকে বিষাক্ত করে তোলে।চরঝাউগড়া গ্রামের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষক বলেন, ‘কারখানার বর্জ্যে আমাদের জমির ঘাস নষ্ট হচ্ছে। গরু খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বিষাক্ত এসব পদার্থের কারণে খালের মাছও মারা যাচ্ছে। জমিতে ফলন হচ্ছে না। ফল হলেও তা খাওয়ার উপযোগী নয়।জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ছাইফুল ইসলাম খান বলেন, ‘জনবহুল এলাকায় কোন সীসা কারখানা থাকতে পারে না, কারণ সীসা ও ব্যাটারির ধোঁয়া মানবদেহে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এতে শ্বাসকষ্ট, কিডনি ও লিভারের রোগ, এমনকি ক্যানসারের মতো জটিল রোগও হতে পারে। শিশুদের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়। কাজেই সংশ্লিষ্টদের উচিত এসব দিক বিবেচনা করে সীসা কারখানার অনুমোদন দেয়া।’ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র বিষয়ক কমিটির ৫২১ তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ডল কর্পোরেশনের পরিবেশগত ছাড়পত্রের ৫, ৬, ৭, ১০, ১২, ১৩, ১৪, ১৬, ১৭ নং শর্তসমূহ লঙ্ঘন, এসিড নিঃসৃত পানি বাহিরে নির্গমন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিক কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব না দিয়ে পুরাতন ব্যাটারি হতে সীসাবার প্রস্তুত কার্যক্রম পরিচালনা করে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন অব্যাহত রেখেছে। সভায় পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করায় মন্ডল কর্পোরেশনের অনুকূলে দেয়া পরিবেশগত ছাড়পত্রটি বাতিলের সুপারিশ গৃহীত হয়।পরিবেশ অধিদপ্তরের সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই দেয়া পরিবেশগত ছাড়পত্রটি বাতিল করা হলো এবং কারখানার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করতে বলা হয় মর্মে মন্ডল কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেনকে উপপরিচালক মেজ-বাবুল আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের কার্যালয়।পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুরে কারখানাটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও র্যাবের যৌথ অভিযানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং কারখানাটি সীলগালা করা হয়েছিল।জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেজবাবুল আলম বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র অনুযায়ী পরিদর্শন করে অনুমোদন দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেয়া পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্তসমূহ লঙ্ঘন করায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ছাড়পত্র বাতিল করে কারখানার সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’তবে বাস্তবে সেখানেই রয়েছে ঘন বসতি ও বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। ফলে প্রশাসনের এই অনুমোদনের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন এলাকাবাসী।তবে কারখানার মালিক মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, ‘আমার কারখানার কারণে পরিবেশের কোন ক্ষতি হচ্ছে না, ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে সীসা পরিশোধিত করে বাতাসে ধোঁয়া ছাড়া হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর আমার কারখানার ছাড়পত্র বাতিল করলেও আমি হাইকোর্টে রিট করে বাতিলের আদেশ স্থগিত করিয়েছি। আর কলকারখানা অধিদপ্তরে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছি, কিন্তু তাঁরা আমার লাইসেন্স নবায়ন করছে না।’স্থানীয়দের প্রশ্ন, সাময়িক জরিমানা আর লোক দেখানো অভিযান করে কি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? তারা চান, কারখানা বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব শিল্প এলাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।চরকালীবাড়ি এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘জরিমানা করে চলে গেলে আমরা আবার আগের কষ্টেই থাকি। সরকার চাইলে তো এসব বন্ধ করা কঠিন না। শুধু উদ্যোগ দরকার।’কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ময়মনসিংহ কার্যালয়ের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘মন্ডল কর্পোরেশনের নামে ২০২২ সালের ২২ জুলাই লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল এবং যার মেয়াদ ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর শেষ হয়। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ঐ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স আর নবায়ন করেনি, আমরা ঐ প্রতিষ্ঠানের নামে আর লাইসেন্স নবায়ন দিব না।’তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি কারখানাটি পরিদর্শন করে বাংলাদেশ শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন পাওয়া যায় এবং কারখানার মালিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয় কিন্তু তাঁরা নোটিশের কোন জবাব দেয়নি।’ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স ইন্সপেক্টর ইফতেখারুল ইসলাম মুরাদ বলেন, ‘মন্ডল কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ জুন মাসে শেষ হবে, এরপর আর লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।’ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ময়মনসিংহের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর রোকনুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ঐ ব্যাটারী কারখানার বিষয়ে তথ্য নিয়েছি, জুনে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নবায়ন করা হবে না।’এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় পরিবেশ অধিদপ্তর দেখভাল করে। কাজেই তাঁদেরাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।’এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর