বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী, সমুদ্রের দুয়ার, আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার চট্টগ্রামকে নিয়ে আবারও সরব হলেন এরই এক সন্তান–চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রতিষ্ঠাতা মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।তার দাবি, ‘চট্টগ্রাম’ শব্দের ইংরেজি রূপ ‘Chittagong’ ছিল কেবল ভাষাগত রূপান্তর নয়, বরং ছিল বন্দরনগরীর শত বছরের ইতিহাস, ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক পরিচয়ের অংশ। বিগত আওয়ামী সরকার যে একক সিদ্ধান্তে এটিকে ‘Chattogram’ করেছে, তা জনগণের মতামত ছাড়াই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর এক প্রকার অজুহাতহীন আঘাত।গত শুক্রবার (২০ জুন) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘সময়ের কণ্ঠস্বর’-এর একযুগপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।অনুষ্ঠানে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ”বাংলাদেশের সব জেলার ইংরেজি নাম বাংলা উচ্চারণে রূপান্তর হলেও শুধু চট্টগ্রামের ‘Chittagong’ শব্দটিই ছিল আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই নাম বাদ দিয়ে ‘Chattogram’ করার মাধ্যমে আমাদের ইতিহাসকে মুছে ফেলা হয়েছে।”তিনি আরও বলেন, ‘তখন কেউ প্রতিবাদ করেনি। তেলবাজির সংস্কৃতি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখানে সরকার যা বলেছে সেটাই সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে প্রতিবাদের, সময় এসেছে আমাদের ঐতিহ্য ফেরত চাওয়ার।’মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, শুধু একটি নাম নয়, ‘Chittagong’ ছিল এ অঞ্চলের আত্মপরিচয়ের একটি প্রামাণ্য ইতিহাস।চট্টগ্রামের ইংরেজি নাম ‘Chittagong’-এর ইতিহাস বহু পুরনো। ব্রিটিশ আমল তো বটেই, তারও বহু আগে থেকেই আরব, চীনা, পর্তুগিজ ও ব্রিটিশ নাবিকেরা এই অঞ্চলের নাম উচ্চারণ করত ‘Chittagong’ নামে। মোঘল আমলে এটি ‘চাটিগাঁও’ নামে পরিচিত ছিল, যা পরে পর্তুগিজ ভাষায় ‘Xatigan’, এরপর ‘Chattigam’ এবং ইংরেজি ভাষায় এসে ‘Chittagong’-এ রূপ নেয়।এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে এই উপকূলীয় শহরের সামুদ্রিক ইতিহাস, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবগাঁথা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠা।বিশ্বখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর, যার ইংরেজি নাম আজও বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ‘Chittagong Port’ হিসেবে, সেটিও পরিবর্তনের চাপে রয়েছে। অথচ ১৩৮ বছর পুরনো এই বন্দরের পুরোনো নামের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে শতশত জাহাজ, কনটেইনার ও আন্তর্জাতিক লগ্নি।মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘Chittagong Port-এর পরিবর্তে Chattogram Port বললে কেউ চিনবেই না। অথচ আজ বাধ্য হয়ে নাম বদলাতে হচ্ছে। এটি শুধু বিভ্রান্তি নয়, একটি ইতিহাসের ধ্বংস।’তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনিক জটিলতাও তৈরি হচ্ছে। বিদেশি নথিপত্রে Chittagong, আর আমাদের নথিতে Chattogram–এতে গ্লোবাল কমিউনিকেশনে সমস্যাও হচ্ছে।’চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গভীরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ”বাংলাদেশ জন্মের আগেই চট্টগ্রাম তথা চিটাগং-এর জন্ম। এই অঞ্চলে পৃথিবীর বহু দেশের বণিকেরা পাড়ি জমিয়েছেন। একে বলা হতো উপমহাদেশের প্রবেশদ্বার। আজও ইউরোপ-আমেরিকার বহু জায়গায় ‘চিটাগং’ নামেই চট্টগ্রাম পরিচিত।”চট্টগ্রাম ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেরও অন্যতম কেন্দ্র। ১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুণ্ঠন—চট্টগ্রামেই ঘটে। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচারিত হয় এই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। সেসব ইতিহাসে ‘চিটাগং’ শব্দটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।মাহমুদুল ইসলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, ”আমরা চাই আমাদের ঐতিহ্য ‘Chittagong’ নামটি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। দেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস নিজেও চট্টগ্রামের সন্তান, আমরা আশাবাদী–তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।” তিনি সাংবাদিকদের প্রতিও আহ্বান জানান, ‘চট্টগ্রামের ঐতিহ্য রক্ষায় আপনাদের ভূমিকা অপরিহার্য। আপনারাই পারবেন জাতিকে জাগিয়ে তুলতে।’এসময় তিনি ‘সময়ের কণ্ঠস্বর’-কে দেশের নির্ভীক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই পত্রিকাটি সাহসিকতা, সততা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে পাঠকের আস্থা অর্জন করেছে। এটি যেন ভবিষ্যতেও গণমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে, সে কামনাই করি।’এসকে/আরআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর