ঈদুল আজহার কোরবানির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা নতুন নয়। তবে এবার চট্টগ্রামে এ চিত্র আরও করুণ ও বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট, অলিগলি ও জনবসতির কাছাকাছি স্থানে পড়ে থাকা পচা চামড়ার স্তূপ শুধু ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত ব্যর্থতার নিদর্শন নয়, বরং এটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিশেষ করে নগরীর বহদ্দারহাট, চকবাজার, দুই নম্বর গেইট, বাদামতলী, অক্সিজেন, পতেঙ্গা ও কর্ণফুলী এলাকার সড়কজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজারো চামড়ায় ইতোমধ্যে পচন ধরেছে। এতে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ, বাড়ছে মশা-মাছির উৎপাত, এবং আশপাশের পরিবেশ হয়ে উঠেছে ভয়ানকভাবে বসবাসের অযোগ্য।এই করুণ দৃশ্য নতুন নয়। ২০১৭ সালেও চট্টগ্রামে একই রকম বিপর্যয় দেখা গিয়েছিল। এ যেন এক দুঃসহ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের ঈদে চট্টগ্রামে প্রায় ৪০ হাজারের মতো কোরবানির চামড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এটি নিছক অব্যবস্থাপনা নয়— চামড়া ব্যবসায় নিয়োজিত কিছু সিন্ডিকেটের সুপরিকল্পিত কারসাজির ফল।চামড়ার বাজারে বিশৃঙ্খলার আরেকটি বড় কারণ হল আড়ৎদারদের অনীহা ও দামের অনিশ্চয়তা। মৌসুমি বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, আড়ৎদাররা সময়মতো চামড়া কিনে নিচ্ছেন না, আবার যেসব দাম প্রচার করা হচ্ছে, বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাচ্ছে না।চট্টগ্রামের বহদ্দারগাট এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী মাহফুজ উল্লাহ সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, ‘আড়ৎদারদের আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। কেউ এল না। বাধ্য হয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছি চামড়া। এখন মানুষ গালমন্দ করছে আমাদের।’চামড়া বিক্রি করে লোকসানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে ২০ বছরের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বেলাল বলেন, ‘গত বছর ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লোকসান গুণেছি। এবারও ৪৫০ টাকায় কেনা চামড়া ৩০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।’সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার জন্য ৫৫ থেকে ৬০ টাকা (সর্বনিম্ন ১,১৫০ টাকা) মূল্য নির্ধারণ করলেও অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী এই দাম কাঁচা চামড়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য মনে করে দাম বাড়িয়ে ফেলেছেন। এতে ব্যাপক বিভ্রান্তি ও ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা।বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহবুবুল আলম সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, ‘আমরা মৌসুমি বিক্রেতাদের বহুবার সতর্ক করেছি— সরকার কেবলমাত্র লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু তারা সেটা না বুঝে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কিনে ফেঁসে যাচ্ছেন।’সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যেসব কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, সেগুলোকে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে পরিবহন ও সংরক্ষণের খরচসহ প্রায় ৫০০ টাকা খরচ পড়ে। এছাড়া ট্যানারি মালিকেরা প্রতিটি চামড়ার ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেন। লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই।’চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চামড়ার এমন অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা দ্রুত পরিষ্কারের চেষ্টা করছি। তবে সময়োপযোগী পরিকল্পনা না থাকলে এই সমস্যা বারবার ফিরে আসবে।’পরিবেশবাদীরা বলছেন, এসব পচা চামড়া থেকে ছড়ানো জীবাণু বাতাস, পানি ও মাটির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এতে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে থেকেই স্থানীয় প্রশাসন, চামড়া ব্যবসায়ী সংগঠন ও পরিবেশ দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের চরম অভাবই এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। চামড়া একটি মূল্যবান সম্পদ, যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেটের প্রভাব ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে এই সম্পদ এখন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে।পিএম
Source: সময়ের কন্ঠস্বর