কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান পুরুষ মহিলার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। এটি ইসলামের মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।  আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব নবীর যুগেই কুরবানি পালিত হয়েছে।এটি ‘শাআইরে ইসলাম’ তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর মাধ্যমে ‘শাআইরে ইসলামের’ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এছাড়া গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তার রাসুলের শর্তহীন আনুগত্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে কুরবানিতে। নবীজিকে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন- আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি আদায় করুন।  (সুরা কাওসার:২)অন্য আয়াতে এসেছে- (হে রাসুল!) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সুরা আনআম: ১৬২)কুরবানি কাদের ওপর ওয়াজিব:প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন-অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারো নিকট কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন তোলা চাঁদির মূল্য সমান হয় তাহলে তার উপরও কুরবানি ওয়াজিব। আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫।মাসআলা: ২. একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানি ওয়াজিব।পরিবারের যত সদস্যের উপর কুরবানি ওয়াজিব তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কুরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানি সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না।নেসাবের মেয়াদ:মাসআলা ৩. কুরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানির তিন দিন থাকলে এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের কিছু আগে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেও কুরবানি ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২কুরবানির পশুর বয়স কত হতে হবে:কুরবানির জন্য উট কমপক্ষে ৫ বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ন্যূনতম ৬ মাস বা তার বেশি বয়সের কোনো ভেড়া বা দুম্বা যদি হৃষ্টপুষ্টতার কারণে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানি করা জায়েজ। ৬ মাসের কম হলে জায়েজ হবে না।উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের  কম হলে তা দ্বারা কোনো অবস্থাতেই কুরবানি করা জায়েজ হবে না। -ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬ এক পশুতে শরীকের সংখ্যা:একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানি দিতে পারবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানি করলে কারোটাই সহিহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানি সহিহ হবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদীস : ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)হারাম উপার্জনকারীর সঙ্গে কুরবানি দেওয়া যাবে?কারো ব্যাপারে যদি একথা নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, তিনি হারাম টাকা দিয়েই কুরবানি দিচ্ছেন তাহলে তার সঙ্গে কুরবানি করা জায়েজ হবে না। এরকম ব্যক্তির সঙ্গে কুরবানিতে শরিক হলে ওই পশুতে শরীক সবার কুরবানি বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করা জরুরি। (খুলাসাতুল ফাতওয়া ৪১৫)পক্ষান্তরে বিষয়টি যদি অজানা থাকে, তাহলে তার সঙ্গে কুরবানি করা জায়েজ হবে।সাত শরীকের কুরবানি:সাতজনে মিলে কুরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানি সহিহ হবে না।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানি করা জায়েজ। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)কুরবানির পশুতে আকিকার অংশ:কুরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানি ও আকিকা দুটোই সহিহ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকিকার গোশত খেতে পারবে। (ইলাউস সুনান ১৭/১২৬)রুগ্ন ও দুর্বল পশুর কুরবানি:এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ নয়। (জামে তিরমিযী ১/২৭৫, আলমগীরী ৫/২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪)দাঁত নেই এমন পশুর কুরবানি:যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫, আলমগীরী ৫/২৯৮)যে পশুর শিং ভেঙ্গে বা ফেটে গেছে:যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানি জায়েজ নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কুরবানি করা জায়েজ। (জামে তিরমিযী ১/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪, আলমগীরী ৫/২৯৭)কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানি:যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানি জায়েজ নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানি জায়েজ। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। (জামে তিরমিযী ১/২৭৫, মুসনাদে আহমদ ১/৬১০, ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮, কাযীখান ৩/৩৫২, আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮)পশু কেনার পর দোষ দেখা দিলে:কুরবানির নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানি জায়েজ হয় না তাহলে ওই পশুর কুরবানি সহিহ হবে না। এর স্থলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে। তবে ক্রেতা গরীব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানি করতে পারবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাওয়াযেল ২৩৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫)কোনো শরীকের মৃত্যু ঘটলে:কয়েকজন মিলে কুরবানি করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১)কুরবানির পশু চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে:কুরবানির পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মরে যায় আর কুরবানিদাতার উপর পূর্ব থেকে কুরবানি ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে। গরীব  হলে (যার উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯)ঋণ করে কুরবানি করা:কুরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানি করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানি করা যাবে না।রাতে কুরবানি করা:জিলহজের ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতে কুরবানি করা জায়েজ। তবে রাতে আলোস্বল্পতার দরুণ জবাইয়ে ত্রুটি হতে পারে বিধায় রাতে জবাই করা অনুত্তম। অবশ্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতে জবাই করতে কোনো অসুবিধা নেই। (ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৬, আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫১০)কাজের লোককে কুরবানির গোশত খাওয়ানো:কুরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েজ নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে। (আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬, ইমদাদুল মুফতীন)কুরবানির গোশত ওলীমা বা অনুষ্ঠানে খাওয়ানো যাবে?কুরবানির গোশত দিয়ে বিয়ে-শাদী, ওলীমাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানেও খাওয়ানো যাবে। এতে কোনো সমস্যা নেই।  কুরবানির গোশত নিজেদের প্রয়োজনমতো যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করা যাবে। তবে কুরবানির সময় শুধু অনুষ্ঠানে ব্যবহারের নিয়তে কুরবানি দেওয়া যাবে না, তাহলে কুরবানিই আদায় হবে না। বরং কুরবানি করতে হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যই। এরপর তা প্রয়োজনমতো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। এফএস

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
এভাবে চললে কিয়ামত পর্যন্ত ঐকমত্য হবে না: ভিপি নূর
এভাবে চললে কিয়ামত পর্যন্ত ঐকমত্য হবে না: ভিপি নূর

এভাবে চলতে থাকলে কিয়ামত পর্যন্তও শতভাগ ঐকমত্য হবে না বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। রোববার (২২ Read more

নাগরপুরে কৃষকদের মাঝে প্রদর্শনীর উপকরণ হস্তান্তর
নাগরপুরে কৃষকদের মাঝে প্রদর্শনীর উপকরণ হস্তান্তর

"পুষ্টি বাগান গড়ি, স্বাস্থ্যকর জীবন গড়ি"এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে অনুপাতি প্রতি জমি Read more

বান্দরবানের জীপ গাড়ি খাদে পরে নিহত ১
বান্দরবানের জীপ গাড়ি খাদে পরে নিহত ১

বান্দরবানের রুমা উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে  জীপ গাড়ি খাদে পরে ঘটনাস্থলেই  ১  জন নিহত হয়েছেন।নিহতের  নাম লাল কাপ এল বম (৪৫)।তিনি Read more

কে এই আল জুলানি?
কে এই আল জুলানি?

Source: রাইজিং বিডি

আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছেই না, সরকারের পদক্ষেপ কী?
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ  কাটছেই না, সরকারের পদক্ষেপ কী?

দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার সেনসদর এক ব্রিফিং করে জানিয়েছে সেনাবাহিনী দেশের সাত শতাধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। লুট Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন