পৃথিবীর প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান নিয়ে প্রকৃতিতে যেমন পাথর তৈরি হচ্ছে, ঠিক তেমন মানবদেহের উপাদান ও খনিজ দিয়ে গঠিত আমাদের শরীরের কয়েকটি অঙ্গে পাথর তৈরি হতে পারে। যেমন: পিত্তথলি, কিডনি, অগ্ন্যাশয়ে পাথর হতে পারে। কিডনি ও মূত্রথলির পাথর এখন খুব সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী বা পুরুষ সবাই এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন।  এই পাথর ক্ষতিগ্রস্ত করছে শরীরের কিডনিকে। আর দেরিতে এই রোগ ধরা পড়ায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। কিডনির পাথর কেন হয়?কিডনিতে পাথর তৈরির কারণ জানার জন্য অনেক গবেষণা হয়েছে এবং চলছে। সাম্প্রতিক ধারণা হলো, প্রস্রাবে দ্রব অত্যধিক ঘন হলে পাথরের কণা বা ক্রিস্টাল তৈরি হয়। এ অবস্থা সৃষ্টি হয় যদি শরীর থেকে প্রতিনিয়ত পানি কমে যায় (ডিহাইড্রেশন)।পাথর তৈরির প্রধান কারণ ডিহাইড্রেশন। যাঁরা গরম আবহাওয়ায় কাজ করেন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, তাঁদের শরীরে পানির পরিমাণ কমে পাথর তৈরির আশঙ্কা বেশি। তাই মরুভূমিতে, মধ্যপ্রাচ্যের গরম দেশগুলোতে এমনকি আমাদের এই উপমহাদেশের কিছু কিছু স্থানে প্রচুর কিডনি পাথরের রোগী পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রস্রাবে বারবার সংক্রমণ থেকেও পাথর হতে পারে। শরীরের কিছু খনিজ উপাদান, যেগুলো পাথর তৈরিতে বাধা দেয় (ইউরিনারি স্টোন ইনহিবিটরস) সেগুলো প্রস্রাবে কমে গেলেও কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন: প্রস্রাবে সাইট্রেট, ম্যাগনেশিয়াম, জিংকের পরিমাণ কমে গেলে।আবার শরীরে এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলোর পরিমাণ প্রস্রাবে বেড়ে গেলে কিডনিতে পাথর তৈরি হতে পারে। যেমন: প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম ও ইউরিক অ্যাসিড বেশি পরিমাণে নির্গত হওয়া। যেকোনো কারণে মূত্রপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে এবং মূত্রতন্ত্রে জন্মগত কোনো সমস্যা থাকলেও পাথর তৈরির আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন মেটাবলিক কারণ যেমন: প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অত্যধিক কার্যকারিতা বা টিউমার রক্তে ও প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে দুই দিকের কিডনিতেই অনেক পাথর তৈরি হয়।কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের পাথরের চিকিৎসাকিডনির পাথর যদি ৪ মিলিমিটার বা তার থেকে ছোট হয়, তাহলে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে যে, সেটি নিজেই প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে আমরা রোগীদের বেশি করে পানি পান করতে বলি। প্রয়োজনে ব্যথার ওষুধ দিয়ে থাকি। আর কয়েক সপ্তাহ পরপর এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান করে দেখি পাথরটা কতটুকু নেমেছে বা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে কি না।ছাঁকনির মধ্যে প্রস্রাব করলে অনেক সময় পাথর ধরা যায় অথবা রোগীরা বুঝতে পারেন যে প্রস্রাবের সঙ্গে জমাট রক্তের মতো কিছু একটা বের হয় বা কমোডের পানির নিচে জমা হয়। কিন্তু পাথর যদি মূত্রনালির বা ইউরেটারের কোনো অংশে আটকে যায় আর নিচে নামে, প্রস্রাবের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে সংক্রমণ হয়, সে ক্ষেত্রে পাথর ছোট হলেও বের করে প্রস্রাবের বাধা দূর করতে হবে। কিডনির পাথর দশমিক ৫ থেকে ২ সেন্টিমিটার আকারের হলে এবং সুবিধামতো জায়গা থাকলে শরীরের বাইরে থেকে শক ওয়েভ দিয়ে পাথর গুঁড়া করা সম্ভব। পরে গুঁড়াগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। কিডনি থেকে ছোট আকারের পাথর অপসারণের আরেকটি মিনিম্যাল ইনভেসিভ পদ্ধতি হলো আরআইআরএস (রেট্রোগ্রেড ইন্ট্ররেনাট সার্জারি)। এই পদ্ধতিতে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে ফেক্সিবিল ইউরেটেরোস্কোপ দিয়ে কিডনিতে পৌঁছে লেজারের মাধ্যমে পাথর গুঁড়া করে বের করে আনা হয়।তবে কিডনির পাথর অপসারণের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি (গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড) হলো পিসিএনএল। এই পদ্ধতিতে ছোট একটি ছিদ্রের মাধ্যমে পিঠের দিক দিয়ে যেকোনো আকার ও প্রকৃতির পাথর ভেঙে ১০০ শতাংশ বের করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও কিডনির পাথর এসব পদ্ধতিতে বের করা হয়। এখন আর পেট কেটে কিডনি পাথরের সার্জারি করা হয় না বললেই চলে। তাই রোগীকে পুরো অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না এবং দুদিনেই বাসায় ফিরে যেতে পারেন। এসব পদ্ধতিতে ব্যথা–বেদনা তেমন একটা হয় না। কিডনির পাথর ইউরেটার বা মূত্রনালিতে নেমে এলে তা ইউরেটেরোস্কোপের মাধ্যমে প্রস্রাবের নালি দিয়ে বের করা হয়। মূত্রথলির পাথরও পেট না কেটে যন্ত্রের সাহায্যে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বের করা হয়।কিডনির পাথর প্রতিরোধের উপায়খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন ও পর্যাপ্ত পানি পান করা কিডনি পাথর প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিডনির পাথর বের করলেও আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যাঁদের একবার পাথর হয়েছে, তাঁদের জন্য কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে।* সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলো পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে যাতে শরীর শুষ্ক না থাকে। কতটুকু পানি আপনার জন্য পর্যাপ্ত, তা নির্ভর করে আপনার কাজের ধরন, অবস্থান ও জলবায়ুর ওপর। যাঁরা বাইরে মাঠে কাজ করেন তাঁদের শরীরে পানির প্রয়োজন নিশ্চিতভাবে ঘরে এসির ভেতর অবস্থানরত মানুষের চেয়ে বেশি। তেমনি গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে বা গ্রীষ্মকালে, শীতপ্রধান অঞ্চলে বা শীতকালে পানির প্রয়োজন বেশি হবে। যাঁদের আগে পাথর হয়েছে তাঁদের বেলায় সাধারণত আমরা বলি এমন পরিমাণ পানি ও তরল পান করবেন, যাতে প্রস্রাব ২৪ ঘণ্টায় ২ লিটারের মতো হয় অথবা প্রস্রাব উচ্চবর্ণের না হয়। এটি দেখতে যেন অনেকটা পানির মতোই হয়। আপনার অবস্থানভেদে ২-৪ লিটার পান করার প্রয়োজন হতে পারে।* কোনো অসুখের কারণে প্রস্রাব প্রবাহে বাধা অথবা সংক্রমণ থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে।* খাদ্যে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে।* মূত্রতন্ত্র বা কিডনি থেকে পাথর বের করার পর আমরা পাথরের রাসায়নিক পরীক্ষা করে থাকি। ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথরের ক্ষেত্রে যেসব খাদ্যে অক্সালেট বেশি থাকে তা কম খেতে হবে। যেমন, পালংশাক, স্ট্রবেরি, মাখন, চকলেট, দুগ্ধজাতীয় খাবার। প্রস্রাবে সাইট্রেট কম থাকলে পটাশিয়াম সাইট্রেট খেতে দেওয়া যেতে পারে। এটি প্রস্রাবে অ্যাসিডোসিস কমায়। অজ্ঞাত কারণে প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম বেড়ে গেলে মূত্রবর্ধক থায়াজাইডজাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড থেকে পাথর হলে লাল মাংস খাওয়া কমাতে হবে; অ্যালোপিউরিনল ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া যেতে পারে।* মেটাবলিক সমস্যার জন্য পাথর হলে তার চিকিৎসা করতে হবে। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা টিউমার থাকলে তার শল্যচিকিৎসা করাতে হবে।* অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন সি (যা শরীরে অক্সালেটে পরিণত হয়) ও ভিটামিন ডি (শরীরের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায়) খাওয়া পরিহার করতে হবে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন শরীরের জন্য ভালো।এবি

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
বরিশালে নাহিদের সামনেই এনসিপি’র দু’পক্ষের হট্টগোল
বরিশালে নাহিদের সামনেই এনসিপি’র দু’পক্ষের হট্টগোল

বরিশালে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের আগমন উপলক্ষে আয়োজিত নবগঠিত দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দু'পক্ষের মধ্যে Read more

উইকিপিডিয়া কীভাবে পরিচালিত হয়, কতটা নির্ভরযোগ্য এর তথ্য?
উইকিপিডিয়া কীভাবে পরিচালিত হয়, কতটা নির্ভরযোগ্য এর তথ্য?

বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানার জন্য বহুল ব্যবহৃত এই মাধ্যম সম্পর্কে প্রায়শই কয়েকটা প্রশ্ন উঠে থাকে - উইকিপিডিয়া কীভাবে কাজ করে? Read more

বরেন্দ্র এলাকায় পানির হাহাকার: মাটির নিচের পানি কোথায় গেলো?
বরেন্দ্র এলাকায় পানির হাহাকার: মাটির নিচের পানি কোথায় গেলো?

মাত্র চল্লিশ বছর আগেও যে এলাকায় পানি ছিলো সহজলভ্য এখন তার অনেক স্থানেই পানির সংকট। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত: নিচে Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন