চায়ের কাপে শুধু ধোঁয়া নয়, জাগে স্বপ্ন- ভেসে ওঠে জীবনের গল্প। অনেকের কাছে চা মানে নিছক এক কাপ পানীয়, কিন্তু নোমান সিদ্দিকীর কাছে চা এক ধরণের আত্মপরিচয়, যা দিয়ে তিনি কেবল পিপাসা নিবারণই করেন না- গড়েন নিজের আত্মনির্ভর জীবনের পথরেখা।কক্সবাজার শহরের হৃদয়জুড়ে ঘুনগাছ তলা পেরিয়ে সমবায় মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ক্ষুদ্র চায়ের দোকান- তবে সাধারণ নয়, নাম “স্মার্ট চা-ওয়ালা”। নাম যেমন অভিনব, তেমনি তার স্বপ্নও স্বতন্ত্র। দোকানটি ছোট হলেও স্বপ্নের পরিধি বিশাল। পরিচ্ছন্ন হাতে, স্নিগ্ধ মননে, যত্নে গড়া প্রতিটি চায়ের কাপ যেন চুমুকে চুমুকে বলে জীবনের গল্প।নোমান বলেন, “চা শুধু পানীয় না ভাই, মানুষের মনের খোরাক। কেউ একা বসে, কেউ গল্প করে, কেউ ভালোবাসা জানায় এই এক কাপ চা দিয়েই।”চা নিয়ে বাংলার যে গভীর সম্পর্ক, তা যেন নোমানের জীবনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চিনের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চা খেয়ে যে ধ্যান-চেতনার সন্ধান পেয়েছিলেন, নোমান যেন সেই সাধনাটিকেই রূপ দিয়েছেন জীবিকায়। তার দোকানে শুধু লাল চা বা দুধ চা নয়, রয়েছে নানা স্বাদের অভিনব আয়োজন: মাল্টা চা, মিক্স মাসাল্লা চা, পুদিনা পাতা চা, হানি লেমন টি, পিনিক তেঁতুল চা, স্মার্ট আদানি চা- এই তালিকা যেমন বিস্তৃত, তেমনি স্বাদের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের শিল্পসুষমা।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহরের ঘুনগাছতলার মোড়ে সন্ধ্যার ভেজা বাতাসে বৃষ্টির ফোঁটা মিশে এক ধরনের নরম নিঃশব্দতা তৈরি করেছে। হালকা বৃষ্টিতে ভিজে উঠেছে সড়ক, দোকানের সামনের টিনের ছাউনিতে টুপটাপ শব্দ পড়ে চলেছে অনবরত। এর মাঝেও ছোট্ট চায়ের দোকানটি যেন নিজের উষ্ণতায় জেগে আছে। “স্মার্ট চা-ওয়ালা” নোমান, এক হাতে ছাতা ধরে, আরেক হাতে চা ঢালছেন পরম যত্নে। টেবিলের ওপর তাজা তিনটি গোলাপের পাপড়ি জলে ভিজে আরও কোমল হয়ে উঠেছে। আশ্রয় নেওয়া পথচারী, কলেজ ফেরত দুই তরুণ, এক টুকরো শুকনো জায়গায় বসে বলছে, “এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় এমন চা না পেলে, দিনটাই অপূর্ণ থেকে যেতো।” দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশাচালক খালি পায়ের আঙুল মুছে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে চুমুক দিচ্ছেন- যেন জীবনের সব ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছে চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে। এই এক কাপ চা, এই এক সন্ধ্যা, আর এই এক নোমান- সব মিলিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে এক অন্তরঙ্গ দৃশ্যপট, যেখানে চা শুধু পানীয় নয়, বরং শান্তির আশ্রয়। একের পর এক মোটরসাইকেল থেমে যাচ্ছে, কেউ ফোনে বন্ধুকে ডাকে- “এই দোস্ত, নোমান ভাইয়ের দোকানে আইসা পড়।” চারপাশে মানুষের মুখে হাসি, হাতে চায়ের কাপ। দোকানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা নোমান যেন নিজের জগতে মগ্ন। দোকানে বসা এক বৃদ্ধ বলছিলেন, “এই চায়ের মধ্যে একটা শান্তি আছে, ঠিক যেন কারও হাতে লেখা চিঠি পড়ে যাচ্ছি।” এমন আবহে বোঝা যায়, নোমানের এই দোকান শুধু ব্যবসার জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে শহরের হৃদয়ছোঁয়া এক অনুভবের কেন্দ্র।প্রতি সকালে তিনটি টাটকা গোলাপ স্থান পায় তার চা টেবিলের উপর। এ যেন এক নিঃশব্দ অথচ সজীব সৌন্দর্য আর সম্মানের প্রকাশ। “মানুষ চোখ দিয়েও চা খায়”- এ কথা যেন হৃদয়ে ধারণ করে তবেই প্রতিটি কাপ প্রস্তুত করেন তিনি।নোমান এক সময় শুধু সাধারণ রং চা বিক্রি করতেন। কিন্তু তাতে পেট চললেও মন চলত না। নিজের স্বপ্নকে এক ধাক্কায় এগিয়ে নিতে ভাবলেন- স্বাদের ভিন্নতা আনবেন। বললেন, “আমি ভাবলাম, যদি স্বাদে নতুন কিছু আনি, তাহলে মানুষ পছন্দ করবে। আর আমিও আলাদা কিছু করতে পারব। তখন থেকেই শুরু করলাম মাল্টি ফ্লেভারের চা বিক্রি।”তার সেই চিন্তা আজ সত্যি হয়েছে। এখন কক্সবাজার শহর তো বটেই, জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও তরুণেরা আসেন শুধুমাত্র এক কাপ স্মার্ট চা-য়ের স্বাদ নিতে। কেউ আসেন মোটরসাইকেলে, কেউবা গাড়ি নিয়ে। কেউ ছবি তোলে, কেউ রিল বানায়। কেউ কেউ আবার তার চায়ের প্রেমে পড়ে টিকটকে “চা মামা” নামে ভাইরাল হয়ে যান।নোমান বলেন, “ওরা যখন ভিডিও করে, আমার দোকানটা নিয়ে কিছু সুন্দর কথা বলে, তখন খুব ভালো লাগে। ওদের হাসিমুখ আর চা খেয়ে মনের তৃপ্তিই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”প্রতিদিন তিনি বিক্রি করেন প্রায় ১০০ কাপ চা। প্রতিটি চায়ের কাপে থাকে যত্ন, সততা ও একরাশ স্বপ্ন। দোকানের খরচ বাদ দিয়ে যা আয় হয়, তার একটা বড় অংশ তিনি পাঠিয়ে দেন ঘরে- একজন গর্বিত সন্তানের মতো।নোমানের গল্প কেবল একজন চা বিক্রেতার গল্প নয়, এটি একজন আত্মবিশ্বাসী উদ্যোক্তার যাত্রা- যিনি বুঝতে পেরেছেন, সাফল্য কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে পাওয়া যায় না, মাটির কাছাকাছি থেকেই মানুষ গড়তে পারে নিজের স্বপ্নের প্রাসাদ।তাকে দেখে মনে পড়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্রের সেই চায়ের বর্ণনা, “আজকাল চায়ের কল্যাণে বাংলা দেশে ভাবের বন্যা এসেছে- ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম।”কলেজ শিক্ষক আলমগীর বলেন, “নোমানের দোকানে চা খাওয়া মানে শুধু চা খাওয়া না, একটা মানসিক প্রশান্তি পাওয়া। দিনের শেষে এখানে বসে এক কাপ ‘মাল্টা চা’ খেলে সব ক্লান্তি উড়ে যায়। আমি বহু জায়গায় চা খেয়েছি, কিন্তু ওর চায়ের স্বাদ, পরিবেশ, ওর ব্যবহারের মতো কিছু খুব কম জায়গায় পাই।”বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জেসমিন আক্তারবলেন, “আমি সাধারণত বাইরে থেকে চা খাই না, কিন্তু নোমান ভাইয়ের ‘পিনিক তেঁতুল চা’ খেয়ে আমি আসক্ত হয়ে গেছি। চায়ের মধ্যে যে এত ভিন্নতা আর সৌন্দর্য থাকতে পারে, সেটা এখানেই বুঝেছি। তার দোকানে মেয়েরাও নিরাপদে বসে চা খেতে পারে- এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, “এই বয়সে এসে শুধু চায়ের স্বাদ না, মনও খুঁজি কোথাও বসে। নোমানের দোকানে এসে মনে হয় নিজের ঘরের উঠোনে বসে আছি। আমি প্রতিদিন একবার হলেও এখানে আসি। ‘স্মার্ট আদানি চা’ আমার প্রিয়। ছেলেটা খুব পরিশ্রমী, ওর মধ্যে একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।”মোটরসাইকেল রাইডার রাজিব হোসাইন বলেন, “আমরা বন্ধুরা প্রায়ই বাইকে করে আসি চা খেতে। নোমান ভাইয়ের ‘চিলি চা’ একেবারে অন্যরকম। ঝাল-টক-মিষ্টির এক মিশ্রণ। এমন চা আমি জীবনে কোথাও খাইনি। আমরা অনেক সময় রিল বানাই, ভাইরাল হয়। কিন্তু ভাই, ভাইয়ের চায়ের স্বাদই ভাইরাল হবার মতো!”ফ্রিল্যান্সার সানজিদা ইসলাম বলেন, “আমি কাজ করি ল্যাপটপে, দিনে ৮–১০ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগলে নোমান ভাইয়ের ‘হানি লেমন চা’ খেয়ে রিফ্রেশ হই। শুধু চা না, উনার দোকানের টেবিলে গোলাপ ফুল দেখে মনটা খুশি হয়ে যায়। এটা ওনার সৃষ্টিশীলতার প্রতীক বলেই মনে করি।”স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা মিজান বলেন, “নোমান ভাই আমার অনুপ্রেরণা। আমরা যারা ছোট খাটো ব্যবসা করি, তাদের জন্য উনি একটা বড় উদাহরণ। ‘চা বিক্রি করেই সাফল্য আসে’- এই ধারণাটা উনি বাস্তবে প্রমাণ করেছেন। উনার ‘কাজু বাদাম চা’ আমি VIPদের আপ্যায়নে নিয়ে যাই, অনেকেই নাম জানতে চায়!”হ্যাঁ, নোমান সেই প্রেমই ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রতিদিন, প্রতিটি কাপে। তাঁর প্রতিটি চা যেন একেকটি কবিতা, যার স্বাদে মিলে জীবনের আনন্দ আর আশার নরম পরশ।তরুণদের জন্য নোমান একটি অনুপ্রেরণার নাম। হয়তো কারও শুরু হবে এক কাপ চা দিয়ে, কিন্তু শেষ হতে পারে এক বিশাল স্বপ্নের জগতে। নোমানের মতো করে যে কেউই বলতে পারেন- “চা-ই আমার জীবন, চা-ই আমার চাওয়া।”এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর