একদিকে কোরবানির ঈদ সামনে। অন্যদিকে জমে উঠছে দেশের বৃহত্তর পশুর হাটগুলোর প্রস্তুতি। ঠিক এমন সময়ে রাজশাহীতে ভারতীয় জাতের গরুর ক্রয়-বিক্রয়ে বাধা প্রদান করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বুধবার (২১ মে) দুপুর ১টার দিকে রাজশাহী বিজিবি সদর দপ্তরের মূল ফটকের সামনে গরু ফিরিয়ে নিতে বিক্ষোভ করেন গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা।গরুর গাড়িগুলো আটকে দেওয়া, হাটে না তুলতে দেওয়া এবং জব্দ করার ঘটনাগুলো ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় জাতের গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করে বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে, আর এসব গরু নিয়েই দেশের পশুর হাটগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ঈদ উপলক্ষে। কিন্তু এবার বিজিবির আচরণ তাদের আর্থিকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।বিজিবির এই অবস্থানকে ‘হঠাৎ কঠোরতা’ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। রাজশাহীর বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আজ বুধবার সকালে গরু বোঝাই করে আসা বহু গাড়িকে আটকানো হয় পথে পথে। কিছু গাড়ি আবার সোজা বিজিবি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজশাহী সিটি হাটসহ আশেপাশের হাটে ওঠানোর আগেই এসব গরু জব্দ করা হয়।আনারুল নামের এক ব্যবসায়ী জানান, “আমি নিজে ইন্ডিয়ান গরু পুষি। সেই গরুসহ পাঁচটা গরু নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে তিনটা ভারতীয় জাতের। সব কাগজপত্র, কাস্টমসের রশিদ আমার কাছে আছে। কিন্তু হাটে পৌঁছানোর আগেই বিজিবি গাড়ি থামিয়ে গরু নামিয়ে নেয়। এখন বলে কাস্টমস থেকে আবার প্রমাণ দিতে হবে। এর মধ্যে দেশে পালিত গরুর কাগজ পত্র কিভাবে দেব। হতে পারে জাত ভারতীয়।”তানোর উপজেলার আতিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যে গরুগুলো কাস্টমস হয়ে এসেছিল, সেগুলো কি হঠাৎ করে আবার অবৈধ হয়ে গেল? এতদিন তাঁরা কোথায় ছিলেন? আর দেশে যদি ভারতীয় গরু অবৈধভাবে আসে তাহলে বিজিবি অবশ্যই সে সম্পর্কে অবগত থাকে। ঈদের হাট শুরু হওয়ার পর থেকেই বিজিবি এমন স্বেচ্ছারিতা চালিয়ে যাচ্ছে।”বিক্ষোভকারী ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, ভারতীয় জাতের গরু বাংলাদেশে একটি স্বীকৃত ও চাহিদাসম্পন্ন পণ্য। এসব গরু শুধুমাত্র সীমানা পেরিয়ে আসেনি, বরং খামারেও পালিত হচ্ছে। অনেক সময় ভারতীয় জাত ব্যবহার করে দেশীয় খামারিরাও উন্নতমানের গরু উৎপাদন করছেন।মোহনপুর উপজেলার সাফিকুল নামের একজন জানান, “আমার গরু ভারতীয় জাতের। কিন্তু আমি গত ৯ মাস ধরে নিজেই এটি লালন পালন করেছি। এখন যদি জাত দেখে বিজিবি বলে এটা ভারতীয় গরু, তাহলে তো এটা অন্যায়। আমার পরিশ্রমের গরু হাটে তুলতে না দিলে আমরা চলব কিভাবে?”এই পরিস্থিতি কোরবানির ঈদের বাজারকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। প্রতিবারের মতো এবারও গরু ব্যবসায়ীরা গরু তুলেছেন হাটে, অনেকেই অগ্রিম বুকিং নিয়েছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ গরু পালনের জন্য জমি বন্ধক রেখেছেন।তাদের ভাষায়, এখন বিজিবি যদি ভারতীয় জাতের গরুর নামে বাজারে তুলতে না দেয়, তাহলে তারা পথে বসবেন। পাবনার শাহাদাত বলেন, “গরু পুষি ঈদের জন্য, হাটে বিক্রি করে পরিবার চালাই। এবার যদি না বিক্রি হয়, তাহলে কী দিয়ে ঋণের কিস্তি দেব? ঈদের আগে কেন এই বাধা?”ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, বুধবার (২১ মে) বিজিবি কর্তৃক অন্তত ২৩ থেকে ৩৭টি গরু জব্দ করা হয়েছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে কোনো লিখিত বা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে রাজশাহী বিজিবি সদর দপ্তর থেকে কেউ ফোন রিসিভ করেননি।পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহী বিজিবি ১ ব্যাটালিয়নের পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে জানানো হয়, যেসব গরু কাস্টমসের মাধ্যমে বৈধভাবে এসেছে, তাদের রশিদ দেখাতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে গরু ফেরত দেওয়া হতে পারে।তবে কর্মকর্তারা সরাসরি ব্যবসায়ীদের সাথে সমাধানে বসে জানিয়ে দেন, “ভারতীয় গরু বাংলাদেশে বিক্রয় নিষিদ্ধ। কেউ কৌশলে আনলেও হাটে তোলা যাবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”গরু ব্যবসায়ীদের মতে, ভারতীয় গরুর বিষয়টি আইনগতভাবে এক ধরনের ধূসর এলাকায় পড়ে। কারণ ভারত থেকে গরু আমদানির নির্দিষ্ট অনুমতি নেই, আবার কাস্টমসের মাধ্যমে এসব গরু কিছুটা বৈধতা পাচ্ছে, এমন নজিরও রয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে বিজিবি কিংবা কাস্টমসের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য তৈরি করছে জটিলতা।এ বিষয়ে এক পশু ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা খায়রুল বলেন, “যদি সত্যিই ভারতীয় গরু নিষিদ্ধ হয়, তাহলে সেটা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে। আজ বৈধ, কাল অবৈধ—এভাবে আমাদের পুঁজি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া যায় না।”বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা শুধু গরু ফেরতের আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন। তারা চাচ্ছেন একটি সুস্পষ্ট সরকারি ঘোষণা, যাতে ভবিষ্যতে এমন সমস্যা আর না হয়।তারা বলেন, “আমাদের জীবিকা গরুর ওপর। হাটে তুলতে না পারলে পরিবারের ঈদই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা সরকারের কাছে স্পষ্ট নীতিমালা চাই।”এমআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর