৪ দিন নিখোঁজ থাকার পর রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকার মেট্রোরেল লাইনের একটি পিলারের পাশ থেকে মাহমুদুল হাসান (২৪) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে মরদেহ উদ্ধারের পর এটি দুর্ঘটনা, খুন না অন্য কিছু? এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলছে এটি দুর্ঘটনা। এদিকে, মর্মান্তিক এই মৃত্যুকে ঘিরে নানা রহস্যের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।নিখোঁজ থেকে মৃত্যুনওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার আশড়ন্দ গ্রামের ছেলে মাহমুদুল ঢাকায় থাকতেন পড়াশোনার জন্য। তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ৫৩তম ব্যাচের (দ্বিতীয় শিফট) শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৬ মে (বৃহস্পতিবার) থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরিবার ও সহপাঠীদের কেউই জানতেন না, তিনি কোথায় গেলেন, কার সঙ্গে ছিলেন কিংবা কী কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।এরপর ১৯ মে (সোমবার দিবাগত রাত) রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকার মেট্রোরেল লাইনের ১২৫ নম্বর পিলারের পাশে তার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মাহমুদুলকে মৃত ঘোষণা করেন।এদিকে তার মৃত্যুকে ঘিরে অনেকেই বলছেন দুর্ঘটনা, অনেকেই বলছে খুন আবার অনেকেই বলছে অন্য কিছু। কিভাবে মৃত্যু হয় শিক্ষার্থী মাহমুদুলের এটি ঘিরেই তৈরি হয়েছে ধুম্রজাল।হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ কি বলছেএদিকে মাহমুদুল হাসান যে হোস্টেলে থাকতো সেই হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রক্টর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আতিকুল ইসলাম মামুন বলেন, মাহমুদুল তার ব্যবহৃত ফোনটি সাথে নিয়েই রাতে ঘুমিয়ে ছিলো কিন্তু সকালে তার ফোনটি পাচ্ছিলো না। পরবর্তীতে ফোনটি খোঁজার জন্য আগের দিন যে জায়গাগুলোতে সে ছিলো সেই জায়গাগুলোতে ফোনটি খোঁজার জন্য বাহিরে যায়। কিন্তু যখন জানতে পারলাম সে হোস্টেলে আসছে না তখন বিষয়টি আমরা তার পরিবারকে জানাই। এছাড়া প্রতিদিন আমরা খোঁজ নিচ্ছিলাম তার পরিবারের কাছে। যেহেতু মাহমুদুলের কাছে ফোন ছিলো না তাই আমরা যোগাযোগ করতে পাচ্ছিলাম না তার সাথে। পরে দুই দিন পর বুয়া রুম পরিষ্কার করতে ধরে তার বিছানার পাশে ফোনটি পায়।তিনি আরও জানান, তার একটু ইগো সমস্যা ছিলো। এছাড়া তার বেশ কিছু স্বভাবগত সমস্যার কারণে তার রুম পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কাউন্সিলিং এর সময় তাকে বুঝানো হয়েছে।এবিষয়ে হোস্টেলের নিরাপত্তা প্রহরী লিটন জানান, সকাল আনুমানিক ১১ টার দিকে মাহমুদুল হোস্টেল থেকে বাহিরে যান তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কোথায় যাচ্ছেন। মাহমুদুল বলেন তার ফোন হারিয়ে গেছে সেই ফোন খোঁজার জন্য বের হচ্ছি। তারপর সে আর হোস্টেলে ফিরে আসেনি। পরে হলের দায়িত্বে থাকা মামুন স্যারকে জানাই বিষয়টা। মঙ্গলবার জানতে পারলাম সে মারা গেছে।পরিবার ও সহপাঠীরা যা বলছেএদিকে নিহত মাহমুদুল হাসানের পিতা ইদ্রিস আলী বলেন, আমার ছেলে মাহমুদুল ঢাকাতে মারা গেছে। আমরা ঢাকা যেতে পারিনি। আমার চাচাতো ভাই রবিউল মাহমুদুলের লাশ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসছে। রাতেই আমরা লাশ দাফন করি। এক্সিডেন্ট নাকি খুন হয়েছে আমরা বলতে পারবো না। আমরা কিছু জানতেও চাইনা। যেটা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। আমরা দাফন কাফন করে ফেলছি আমাদের আর দেখার বিষয় নাই। যেহেতু আমার ছেলে দুনিয়াতে নেই আমরা বিচার চাই না।মাহমুদুল হাসানের রুমমেট সাদিক বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারটার দিকে আমি রুমে আসি। আসার পর দেখি মাহমুদুল ভাই নিজেই নিজের সাথেই একা একা কথা বলছে। আমার কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক এবং কোন সমস্যা আছে মনে হলো। আমি এসব প্রশ্ন করতেই তিনি অস্বীকার করলেন। পরে ঘুমানোর আগে তিনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বললেন। ঘুম থেকে ওঠার পর আমাকে বলতেছে আমার ফোন নাকি হারিয়ে গেছে এটা খুঁজতে বাহিরে যাচ্ছি। এই বলে সে চলে গেল। এই মৃত্যুটা আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, এই মৃত্যু কখনো স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। ফোন হারিয়ে যাবার পরের চার দিন পর্যন্ত সে কোথায় ছিল? এই প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলোবিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী প্রক্টর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আতিকুল ইসলাম মামুন বলেন, মাহমুদুলের কাছে ফোন না থাকায় আমরা যোগাযোগ করতে পাচ্ছিলাম না। তবে তার পরিবারের সাথে সবসময় যোগাযোগ করে তার খোঁজ নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মাহমুদুলের নিহতের খবর জানার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন শিক্ষক থানায় গিয়েছি। আমরা মাহমুদুলের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করেছিলাম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয় তার পরিবারের কাছে দাফন কাফনের জন্য।ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল বাসেত বলেন, আমি সকাল দশটার দিকে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারি। পরে সহকারী প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম এবং ডিপার্টমেন্টের কো-অর্ডিনেটর আবিদ হাসানকে সেখানে যেতে বলি। তারা আমাকে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করে। আমরা প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা তার পরিবারের নিকট দিয়েছি।পুলিশ যা বলছেপল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, কুর্মিটোলা মেডিকেলে একটা লাশ এসেছে এমন সংবাদ পেয়ে দ্রুত একটি টিম সেখানে যায়। গিয়ে দেখা যায় কিছু লোক তাকে রেখে চলে গেছে। ডাক্তার আমাদের প্রাথমিকভাবে বলেন এটি একটি দুর্ঘটনা। পরবর্তীতে আমরা লাশের পরিচয় পাই। পোস্টমর্ডেম শেষে লাশ তার আত্নীয় রবিউলের কাছে বুঝে দেয়া হয়। এবিষয়ে তার পরিবার থেকে কোন মামলা করেনি।সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে ছাত্রদলের মানববন্ধনএদিকে মাহমুদুলের মৃত্যুর ঘটনায় সঠিক তদন্তের দাবিতে বুধবার (২১ মে) মানববন্ধন করেছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এসময় ডিআইইউ ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম চাঁদ বলেন, ফোন খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া এবং তার মৃত্যু কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না। নিখোঁজ হওয়ার পর সে কোথায় ছিলো সেই প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে। আমরা চাই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করা হোক।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর